কওমী মাদ্রাসা কখন প্রতিষ্ঠা হয়? এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জেনে নিন

 


কওমী মাদরাসার ইতিহাস – আল্লামা সুলতান যওক

ইসলামী শিক্ষা ও ক্বওমী মাদরাসার গোড়াপত্তনঃ

মহানবী সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মদ সা. ৫৭০ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৬১০ খৃষ্টাব্দে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন৷ তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির সাথে সাথেই ইসলামী শিক্ষার সূচনা হয় পবিত্র মক্কা নগরীতে৷ ৬২২ খৃষ্টাব্দে মদীনায় হিজরত এবং তথায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে মক্কার কাফেরদের অকথ্য নির্যাতন ও নিপীড়নের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতেও ইসলামের দা’ওয়াত ও তা’লীম (প্রচার-প্রসার ও শিক্ষা-দীক্ষা) আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে, সুদূর সিরিয়া ও লোহিত সাগরের ওপারে আবিসিনিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যায়৷

হিজরতের পর মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে স্থল ও জল পথে দলে দলে দাওয়াতী কাফেলা বের হয় চতুর্দিকে৷ সেই মুবারক কাফেলাসমূহের এক বা একাধিক কাফেলা আমাদের দেশেও আগমন করে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে৷ মতান্তরে রাসূলুল্লাহর সা. জীবদ্দশায় অথবা তাঁর ইনতিকালের পর সাহাবায়ে কেরামের যুগে এদেশে ইসলামের আগমণ ঘটে ও তার পার্শবর্তী অঞ্চলগুলোর বণিক ও ইসলাম প্রচারকদের মাধ্যমে৷

গণমানুষ ইসলামের সাম্য-সংহতি-ভ্রাতৃত্ববোধ ও সুশৃংখল জীবন যাপনের দৃশ্য দেখে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে৷ ফলে নওমুসলিমদের শিক্ষা-দীক্ষার স্বাভাবিক দায়িত্ব এসে পড়ে দ্বীনের প্রচারকমন্ডলীর ঘাড়ে৷

সুতরাং, তাদের অনেকে ইসলামের প্রচার-প্রসার ও নওমুসলিমদের শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজনে এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন৷ বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও খানকাহ নির্মাণপূর্বক দাওয়াত ও তালীমের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন সুচারুরূপে৷ ক্রমান্বয়ে এসকল মসজিদ ও খানকাহ ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে৷ শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী ও নারী-পুরুষ সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা গ্রহণ করায় এ শিক্ষা গণশিক্ষার রূপ ধারণ করে৷ তাই এ শিক্ষার আক্ষরিক নাম দেয়া হয় “ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা”৷

সরকারী কোন পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই গড়ে ওঠা এ শিক্ষা ব্যবস্থার যাবতীয় ব্যায়ভার বহন করতে থাকে স্থানীয় মুসলমানগণ৷ ১১৯৭ খৃষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বিন মুহাম্মদ বখতিয়ার উদ্দীন খিলজী কর্তৃক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যনত্ম বাংলায় ইসলামী শিক্ষার গতি-প্রকৃতি এরকমই ছিল৷


ঐতিহাসিকগণ রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা তথা ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষাকে চারটি ধাপে ভাগ করে থাকেন৷ যথা :

১. খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথমার্ধে সূচনাকাল থেকে ১১৯৭ খৃষ্টাব্দে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা পর্যনত্ম ছয়শত বছরেরও অধিককাল৷

২. ১১৯৭ খৃ: হতে ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে বৃটিশ কর্তৃক ক্বওমী মাদরাসা রহিত করে তদস্থলে পাশ্চাত্য সেকুলার শিক্ষা প্রবর্তন পর্যন্ত ( সর্বমোট ৫৬৮ বছর )৷

৩. ১৭৬৫ খৃ: হতে ১৯৪৭ খৃষ্টাব্দে ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ( মোট ১৮২ বছর )৷

৪. ১৯৪৭ খৃ: হতে চলমান যুগ পর্যন্ত ৷

কিন্তু আমাদের বিবেচনায় বিভক্তি হবে নিম্নরূপ:

১. সপ্তম শতাব্দী হতে ১১৯৭ খৃ: চার শতাধিক বছর পর্যন্ত ৷

. ১১৯৭ খৃ: হতে ১৭৬৫ খৃ: (৫৬৮) বছর৷

৩. ১৭৬৫ খৃ: হতে ১৮৬৬ খৃ: দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত ৷

৪. ১৮৬৬ খৃ: হতে ১৯৪৭ খৃ: (৮১) বছর৷

৫. ১৯৪৭ খৃ: হতে চলমান কাল পর্যন্ত ৷*

১১৯৭-১৭৫৭ মুসলিম শাসনামলকে ইসলামী শিক্ষার স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ প্রাথমিক যুগ হতে এ শিক্ষা মসজিদ ও খানকাহ ভিত্তিক হলেও পরবর্তীতে আলাদা ক্যাম্পাস ও ভবনের প্রচলন ঘটে৷ তখনকার আমলে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক এক পরিপূর্ণ এ্যাডুক্যাশনাল কারিকুলাম চালু ছিল৷ এ কারিকুলামের অধীনে প্রাইমারী লেভেল থেকে ইউনিভার্সিটি লেভেল পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষা হিসেবে প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল এ ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা৷

বাংলায় সর্ব প্রথম ইসলামী উচ্চ শিক্ষার প্রবর্তন করেন প্রখ্যাত বুযর্গ, বিদগ্ধ হাদীস বিশারদ ও মুজাহিদ শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামাহ রহ.৷ (মৃতু্য-১৩০০খৃ:) সোনারগাঁও-এ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্বওমী মাদরাসা সারা ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়ে বিশ্বময় খ্যাতি অর্জন করে৷ সোনারগাঁও মাদরাসা কেন্দ্রীক আরো উচ্চ মানের বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদসহ বাংলার বিভিন্ন এলাকায়৷

সে যুগে সমগ্র বাংলায় ছোট বড় কত মাদরাসা ছিল, তার সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয় করা কঠিন৷ তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে সুবে বাংলা বৃটিশ কর্তৃত্বাধীন চলে গেলে তারা বিভিন্ন প্রকারের ৮০ হাজার মাদ্রাসা আবিস্কার করে৷ পরবর্তীতে এসব মাদরাসা বন্ধ করে দিয়ে সেগুলোর ওয়াকফিয়া সম্পদ জব্দ করে নেয় বৃটিশ সরকার৷

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম শাসনামলে সুবে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল বেসরকারী৷ 

বৃটিশ কর্তৃপক্ষ যখন বাংলার ৮০ হাজার ক্বওমী মাদরাসা বন্ধ করে দেয় এবং সেগুলোর সমুদয় সম্পদ জব্দ করে নেয়, তখন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন ধ্বস নেমে আসে তেমনি মাদরাসাগুলির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কর্মচুত্য হয়ে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হন৷ 

অপরদিকে ইংরেজরা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জনের স্বার্থে যেমন লুটেরা অর্থনীতি চালু করে তেমনি এদেশের শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির কবর রচনা করে তদস্থলে পাশ্চাত্য বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করে৷ যা মুসলমানরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন৷

১৭৮০ খৃষ্টাব্দে কলকাতা আলীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত কোন মুসলমানের সন্তান ইংরেজ প্রবর্তিত ও পরিচালিত কোন স্কুল – কলেজে যায়নি৷ অভিভাবকবৃন্দ মসজিদ ও কাঁচারি ঘরে সীমিত পরিসরে হলেও সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতে থাকেন৷ কিন্তু সুচতুর ইংরেজ মুসলমানদের এ অসহযোগকে তাদের কর্তৃত্বের প্রতি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে আখ্যা দেয়৷ এ দেশের সুশিক্ষিত মুসলমানদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা অসম্ভব ব্যাপার বলে বুঝে ফেলে৷ তাই তারা স্বতন্ত্র ইসলামী শিক্ষার নামে ১৭৮০ খৃষ্টাব্দে কলকাতা আলিয়া মাদরাসার গোড়াপত্তন করে৷ কলকাতা মাদরাসাকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ এ মাদারাসার সর্ব প্রথম হেড মাওলানা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষা কারিকুলাম “দরসে নেযামী” প্রণেতা মোল্লা নেযামুদ্দীন রহ.’র সুযোগ্য শীষ্য মোল্লা মজদুদ্দীন৷

তিনি প্রাথমিক অবস্থায় দরসে নেযামী প্রচলন করলেও মাত্র এগার বছর পর বৃটিশ সরকার ১৭৯১ সালে ইসলামী শিক্ষার মূলভিত্তি তাফসীর-হাদীস ও উসূলে ফিক্বহকে সিলেবাসের আবশ্যিক বিষয়াবলী হতে বাদ দেয় এবং আবশ্যিক বিষয় হিসেবে আরবী গ্রামার, মানতেক, দর্শন, অংক ও জ্যোতির্বিদ্যাকে রাখা হয়৷ অপরদিকে প্রশাসনিক দায়িত্বও কেড়ে নিয়ে সম্পূর্ণ ইংরেজ কর্তৃত্বাধীন এবং তাদের ধ্যান-ধারণা পরিপুষ্ট একটি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, যা সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার মতো সেই বৃটিশ আমল থেকে সরকারী স্বীকৃতি প্রাপ্ত৷

পক্ষানত্মরে যে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা আবহমানকাল থেকে মুসলমানদের সোনালী ঐতিহ্য ও গৌরবদীপ্ত ইতিহাস লালন ও বহন করে আসছে তার কোন হিসাব সরকারী দপ্তরে নেই৷

উপমহাদেশে ক্বওমী মাদরাসার ইতিকথা ও দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাঃ

১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে পলাশীর ট্রাজেডী হতে ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে মোঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সম্রাট বাহাদুর শাহের পতন পর্যন্ত সারা ভারত বর্ষে বিরাজ করেছিলো এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি৷ বিশেষত: বৃটিশদের দমন নিপীড়ন ও সমপ্রসারণ নীতির ফলে তাদের একমাত্র পথের কাঁটা ও শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে পরিচিত আলেম-ওলামা ও স্বাধীনতাকামী দ্বীনদার মুসলমানদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয় ও লোমহর্ষক৷ গোটা ভারত বর্ষে বৃটিশ শাসন পাকাপোক্ত হয়ে গেলে ভারতের তত্‍কালীন শীর্ষ আলেম ও মুহাদ্দিস, আযাদী আন্দোলনের পুরোধা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর রহ. সুযোগ্য পুত্র এবং আযাদী আন্দোলন ও ইসলামী শিক্ষা -দীক্ষায় তাঁর উত্তরসূরী শাহ আব্দুল আযীয রহ. ভারত বর্ষকে ‘দারুল হারব’ (শত্রুকবলিত এলাকা) হিসেবে ফতওয়া দিলে ভারতীয় মুসলমান বিশেষত: আলেম-ওলামা আযাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন৷

কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! আযাদী আন্দোলনের প্রথম সেনানায়ক ফতেহ আলী খান প্রকাশ সুলতান টিপু ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে ও ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. শাহাদাত বরণ করলে ইংরেজ দস্যৃদের জুলুম-নিপীড়ন অতিমাত্রায়

বৃদ্ধি পায়৷ ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ধারক-বাহক ও “বৃটিশ খেদাও” আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী আলেম-ওলামাই ছিলেন ইংরেজদের এক নম্বর শত্রু৷ তাই এ অভিযান নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়লো: যেমনভাবেই হোক তাদের খতম করতেই হবে৷ এ নিষ্টুর অভিযানে তারা সফলও হয়৷

১৮৬৪-১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে প্রায় সব আলেমকে ইতিহাসের নির্মমতম পদ্ধতিতে হত্যা করে৷ উজাড় হয়ে যায় লাখ লাখ ক্বওমী মাদরাসা৷ ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠত দিল্লীস্থ মাদরাসা রহীমিয়া বুলডোজার দিয়ে ধুলিস্যাত্‍ করে দেয়৷ এভাবে প্রায় সকল মাদরাসা ধবংস করে দেয় বৃটিশরা৷ এমতাবস্থায় ওলামায়ে কেরামের মধ্যে যারা অবশিষ্ট ছিলেন, তারা আন্দোলনের ধরণ পরিবর্তন করলেন৷ ইংরেজদের কোপানল থেকে ভারতীয় মুসলমানদের সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ওলামায়ে কেরাম স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, আর রক্ত ও রক্তক্ষরণ নয় মেধা ও মণীষার সংরক্ষণই হবে বুদ্ধিমানের কাজ৷

এই অভিনব মহাকৌশলের উদ্ভাবক ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত আল্লামা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী রহ.৷ তিনি স্বীয় শিষ্য, সহচর ও শুভাকাঙ্খীদের সমন্বিত প্রয়াসে ১৮৬৬খৃ: ১২৮৩ হি: উত্তর প্রদেশের সাহারাণপুর জেলাধীন দেওবন্দ নামক অখ্যাত গ্রামে ভিত্তি স্থাপন করলেন সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দ৷

ইসলামী শিক্ষা তথা ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য ও গৌরব পূণরুজ্জীবিত করণে দারুল উলূম দেওবন্দের অবদান যেমন অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়কর, তেমনি ‘‘বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে’’ এর ভূমিকাও ছিলো অগ্রগণ্য৷ ইংরেজদের দুর্ভিসন্ধিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণে এদেশে ইসলামের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক ক্বওমী মাদরাসার শিক্ষা বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল৷ দারুল উলূম দেওবন্দ শুধু ভারতবর্ষে তার মিশন বাসত্মবায়নে সফল হয়েছে তা নয়; বরং আফ্রো-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (বিটিশ উপনিবেশসমূহে) এ শিক্ষার ব্যবস্থা প্রচলন ঘটাতে সক্ষম হয়৷

আজ সারাবিশ্বে ক্বওমী চিন্তাধারার লাখো মাদরাসা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর নিরলস খিদমত করে যাচ্ছে৷ ক্বওমী ও আলীয়া উভয় ধারার সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত প্রায় কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন দেওবন্দী আলেমগণ৷ এতদ্ব্যতীত বহুমূল্যবান কিতাবের বিভিন্ন ভাষায় সরল ও সফল অনুবাদ করে অনুবাদ শিল্পে নতুন সংযোজন করেছেন তাঁরা৷ দাওয়াত ও তাবলীগের ক্ষেত্রে বিশ্বময় তাবলীগী জামাআতের অবদান অস্বীকার করা যায় না৷ তাবলীগী জামাআতের প্রণেতা ও রূপকার ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দেরই কৃতি ছাত্র হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ রহ.৷

অতএব, ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত সত্য হচ্ছে, ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামের মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তা সংরক্ষণের মাধ্যমে দ্বীনি দাওয়াত ও তা’লীম-তারবিয়াতের এক বিশ্বজনীন ইসলামী মিশন৷ গোটা ভারতবর্ষ যখন বর্বর বৃটিশের হাতে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও গোটা জাতি সত্মব্ধ, তখনই বৃটিশ তাড়ানোর অদম্য বাসনা নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দেন বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিনতাবিদ ও মুহাদ্দিস, ক্বওমী মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় সুশিক্ষিত আলেমে দ্বীন, দিল্লীর রহীমিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.৷

পরবর্তীতে তাঁর উত্তোলিত স্বাধীনতা সংগ্রামের ঝান্ডা সমুন্নত রাখেন তাঁরই সুযোগ্যপুত্র শাহ আব্দুল আযীয রহ., শহীদে বালাকোট সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রহ. হযরত মাওলানা ইসমাঈল শহীদ রহ., হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ., হাফেজ যামেন শহীদ রহ., মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুভী রহ., মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী রহ., হাজী শরীয়তুল্লাহ, ফাতেহ আলী (সুলতান টিপু), নেসার আলী তিতুমীর, মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রহ. প্রমূখ৷

১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে রক্তস্নাত আযাদী আন্দোলনের কাঙ্খিত ফল “স্বাধীনতা” অর্জিত হয় ১৯৪৭ সালে৷ শাহ ওয়ালী উল্লাহর হাতে সূচিত ঐতিহাসিক আযাদী আন্দোলন কিছু দিন পরে হলেও দারুল উলূম দেওবন্দের কৃতিসনত্মান শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান, হযরত সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী প্রমূখের হাতেই পূর্ণতা লাভ করে৷ আলেম-ওলামা ও ইসলাম প্রিয় মুসলমানদের রক্তঝরা আন্দোলনের ফসল স্বাধীনতাপূর্ব বৃহত্তর পাকিস্তান এবং আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ স্ব-মহিমায় বিদ্যমান৷

লেখকঃ প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক

জামি’আ দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া চট্টগ্রাম

1 Comments

Post a Comment

Previous Post Next Post
icon যে কোন প্রয়োজনে টেলিগ্রাম চ্যানেলে মেসেজ দিন