মেহমানের গুরুত্ব, মেজবান ও মেহমানের আদব, এবং হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও এক ভিক্ষুকের ঘটনা এবং অসাধারণ দু'টি মেহমানদারির কথা!!
মেহমানের গুরুত্বঃ
الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين و على آله و صحبه اجمعين وبعد
●● রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনঃ আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যে ঈমান রাখে সে যেন মেহমানের সমাদর করে। (সহীহ বুখারীঃ ৬১৩৬)
●● অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
যে মেহমানদারি করে না তার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই। (মুসনাদে আহমাদঃ ১৭৪১৯)
●● আরেক হাদীসে নাবী কারীম সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রাঃ)কে লক্ষ্য করে বলেনঃ নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার মেহমানের হক রয়েছে। (সহীহ বুখারীঃ ৬১৩৪)
●● মেহমানদারির এ গুণে গুনাম্বিত ছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। তাঁর মেহমানদারির বর্ণনা পবিত্র কুরআনে কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে। আজকের অবসরে প্রথমেই মেজবান ও মেহমানের কিছু আদব সম্পর্কে আলোচনা করব। যাতে আমরা মেহমানের যথাযথ সমাদর করতে পারি এবং মেহমানদারির পরিপূর্ণ ফযীলত লাভ করতে পারি।
■ মেজবান ও মেহমানের কিছু আদবঃ
মেহমানদারি একটি মহৎ গুণ! যা আত্মীয়তার বন্ধনকে মজবুত করে, বন্ধুত্বকে করে সুদৃঢ় এবং সামাজিক এবং পারস্পরিক সৌহার্দ সৃষ্টিতে বড় ধরণের ভূমিকা রাখে। মেহমানদারি মুসলিমের একটি বিশেষ গুণ। বিভিন্ন নাবী-রসূল এবং সাহাবা-চরিত অধ্যয়ন করলে আমরা মুসলিমের এ গুণের অনন্য নজীর দেখতে পাই। সকল আনসার-মুহাজিরদের মেহমানদারির নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে মেলা ভার। আর তাঁরাই আমাদের পূর্বসূরী।
● মেহমানদারি ছিল আমাদের নাবীজী সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নাবীজী সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হওয়ার পর যখন তিনি হয়রান-পেরেশান হয়ে খাদিজা (রাঃ) এর কাছে আসলেন, তখন খাদিজা(রাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেনঃ
আল্লাহ আপনাকে অপদস্থ করবেন না।
এরপর নাবীজী সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে উত্তম গুণাবলীর উল্লেখ করেছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল- وَتَقْرِي الضَّيْفَ "আপনি তো মেহমানের সমাদর করেন!" নাবীজী সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লামের এ সুন্নতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁর হাতেগড়া সকল সাহাবায়ে কেরামগন (রাঃ)
●● মেজবানের আদব হলো,
সাধ্যানুযায়ী মেহমানের সমাদর করা!
মেহমানের জন্য প্রয়োজনীর আপ্যায়ণের ব্যাবস্থা করা!
মেহমানের সাথে হাসিমুখ কথা বলা এবং মেহমানের জন্য সুন্দর ভাবে বিশ্রাম এবং অন্যান্য সকল আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করা এবং কোন ভাবেই তার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা!
● অনুরূপ ভাবে মেহমানের আদব হলো,
অযথা বেশি সময় মেজবানের কাছে অবস্থান না করা এবং মেজবানের সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং মেজবানের মেহমানদারির উপর সন্তুষ্ট থাকা!!
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও ভিক্ষুকের ঘটনা
একবার হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর নিকট এক ভিক্ষুক আসলো। তিনি ভিক্ষুককে খাবার দিলেন এবং বললেন যে, "বিসমিল্লাহ বলে শুরু কর।" ভিক্ষুকটি বললোঃ "বিসমিল্লাহ বলব কেন?
আমি তো আল্লাহকে বিশ্বাস করি না!" ইব্রাহিম (আঃ) এ কথা শুনে ভিক্ষুকের কাছে থেকে থালা কেড়ে নিলেন এবং বললেনঃ "যাও! তুমি আল্লাহকে বিশ্বাস কর না, তোমাকে খেতে দিব না।
ভিক্ষুক তাঁর ঘরের দরজা থেকে বেরিয়েছে মাত্র, আল্লাহ তা'আলা তৎক্ষণাৎ ইব্রাহীম (আঃ) এর উপর ওহী নাযিল করলেনঃ "হে ইব্রাহীম! সে আমাকে বিশ্বাস করে না সেটা তার আর আমার মধ্যকার ব্যাপার! কেন তুমি রুটি ফিরিয়ে নিলে, যাও তাকে ডেকে এনে আবার খেতে দাও। সুবাহানাল্লাহ! আল্লাহ কত দয়াশীল!
■■ মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব কেন বলছেন? কারণ, আল্লাহ মানুষকে নিজস্ব ইচ্ছা দিয়েছেন! ফলে মানুষ আল্লাহকে মানতেও পারে, নাও মানতে পারে। মানলে জান্নত, আর না মানলে জাহান্নাম। কিন্তু কাউকে জোর করে আল্লাহকে মানানোর অধিকার আল্লাহ মানুষকে দেননি! তবে আল্লাহ পৃথিবীতে যে নিদর্শন রেখেছেন,তাতে কেঊ নাস্তিক থাকতে পারে না। সামান্য বুদ্ধি থাকলেও যেকেউই বুঝতে পারবে পৃথিবীর এতোকিছু এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি! কেউ না কেঊ সৃষ্টি করেছেন এবং সুশ্রিংখল ভাবে পরিচালনা করছেন। অবশ্যই একজন স্রষ্টা আছেন!!
📌অসাধারণ দু'টি মেহমানদারির কথাঃ
হযরত আবু হুরায়রা(রাঃ) বলেনঃ একজন লোক রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললঃ আমি প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের নিকট (খাবারের সন্ধানে) লোক পাঠালেন। কিন্তু তাঁরা বললেনঃ ঐ সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহ পাঠিয়েছেন! আমাদের নিকট পানি ব্যতীত অন্য কোন খাদ্য নেই!
তখন রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম (উপস্থিত সাহাবী (রাঃ) গণকে) বললেনঃ তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে এর মেহমানদারী করবে? আল্লাহ তার প্রতি দয়া করবেন। তখন আনছারী সাহাবী (হযরত আবু তালহা (রাঃ) বললেনঃ
আমি করব। অতঃপর তিনি মেহমানকে সাথে নিয়ে বাড়ি গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেনঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মেহমানকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো। কোন খাদ্য জমা রাখবে না।
▪তাঁর (স্ত্রী) বললেনঃ আল্লাহর কসম! শিশুদের জন্য রাখা খাদ্য ছাড়া আমাদের কাছে আর কোন খাদ্য নেই! আবু তালহা(রাঃ) বললেনঃ খাবার প্রস্তুত করো, বাতি জ্বালিয়ে দাও এবং সন্তানরা যখন রাতের খাবার খেতে চাইবে তখন তাদের ঘুম পাড়িয়ে দিবে। তাঁর স্ত্রী খাবার প্রস্তুত করলেন, বাতি জ্বালালেন এবং তার শিশুদের ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। অতঃপর আবু তালহা (রাঃ) দাঁড়ালেন এবং বাতি ঠিক করার ভাব দেখিয়ে তা নিভিয়ে দিলেন। অতঃপর তারা দু'জনে (মেহমান এবং তিনি অন্ধকারে) খাবার খাওয়ার ভান করলেন। এরপর পুরো খাবার মেহমানকে এনে দিলেন। মেহমান খেলেন এবং তারা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সহ তাঁদের সন্তানরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত্রি যাপন করলেন।
অতঃপর আবু তালহা (রাঃ) সকালে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ
গত রাতে মেহমানের সাথে তোমাদের উভয়ের কর্মকান্ড দেখে আল্লাহ হেসেছেন (খুশি হয়েছেন) এবং নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল করেছেনঃ
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্থ হ’লেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম। (হাশর ৫৯/৯)।
📚 সূত্রঃ বুখারী হা/৩৭৯৪; বায়হাকী, সুনানুল কুবরা হা/৭৮০২; সিলসিলা ছহীহা হা/৩২৭২।।
০২] অসাধারণ মেহমানদারিঃ গত পাঁচ হাজার বছর ধরে চলছে যে মেহমানদারী!!
■গত পাঁচ হাজার বছর ধরে চলছে নাবী ইব্রাহিম (আঃ) এর মেহমানদারিঃ যে শহরে কেউ ক্ষুধার্ত থাকে না!
না! এটি কুয়েত, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন বা ওমানের কোন শহরের ঘটনা নয়! এটি ফিলিস্তিনের ছোট্ট একটি শহর "মদীনাতু খলীল বা খলীল শহর- এর ঘটনা!
এখানে একটি মসজিদ আছে, যা "মসজিদে ইব্রাহীম নামে পরিচিত! এই মসজিদটি সংলগ্ন একটি রেষ্ট হাউস বা মুসাফিরখানা আছে! ওই মেহমান খানার রান্না ঘরে, এখানের গমগুঁড়া ও গোশত মিশিয়ে ওদেশের জাতীয় খাবার তৈরি করা হয়! সেই খাবার প্রতিদিন দুপুরে ৫০০ থেকে ৩,০০০ পরিবারের সদস্যরা পরিতৃপ্তির সাথে খেয়ে থাকেন!
●● এই খানা তৈরি এবং পরিবেশনের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা যুগ যুগ ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন! ঐ শহরের বিত্তবানদের সহায়তায় বছরের প্রতিদিনই এই কর্মসূচি চালু আছে!
● উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, সুলতান সালাহউদ্দিন আইউবী (রহঃ) এবং পরবর্তী সময়ে সুলতান কালূন সালেহী ১২৭৯ খৃঃ সালে এই মুসাফির খানা আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন! তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানানঃ
-এ সিলসিলা চালু আছে নাবী ইব্রাহিম খলিল (আঃ) এর যামানা থেকেই! কারণ তিনি মেহমান ছাড়া খাবার খেতে বসতেন না!"
■■ "তাকিয়ায়ে ইবরাহিমী" নামে পরিচিত এই খাবার খাওয়ার জন্য অনেক দূর থেকেও মুসাফিরগণ সমবেত হয়ে থাকেন! তাদের থাকার জন্য এখানের মেহমান খানায় অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা রয়েছে!
■▪বর্তমানে মসজিদে ইব্রাহিমীর সম্প্রসারণ এবং সংস্কারের জন্য মুসাফির খানাটি একটু দূরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং এটিও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
●● উল্লেখ্য যে, খাবার পরিবেশন সহজিকরণ এবং ভিড় এড়াতে খাবার খেতে আগ্রহী পরিবার গুলোকে পাঁচজন লোকের খাবার নেয়ার মত একটি বড় পাত্র নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলা হয়ে থাকে!
▪এখানকার স্হানীয় বাসিন্দাদের মতে, হযরত ইব্রাহিম খলিল আলাইহিস সালাম এর মেহমানদারি গত পাঁচ হাজার বছর ধরে বংশানুক্রমে চলে আসছে! সুতরাং মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি পরিবার মেহমানদারির চমৎকার এই সুন্নাহটি চালু রাখতে যদি সচেষ্ট হন, তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম হয়তো তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে ইন শা আল্লাহ!
● খলীল শহরের দানশীল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, "এখানে কেউ ক্ষুধার্ত থাকলে আমরা খুবই লজ্জিত হবার ভয়ে আপ্রান চেষ্টা করি সবাইকে খাবার খাওয়ানোর! আল্লাহর রহমতে কখনো কোন অসুবিধা হয় নি এবং হয় না!"
লেখকঃ মুহাম্মদ মীযানুর রহমান
গ্রুপঃ কলম চলবে সত্য প্রকাশে
Post a Comment