আমাদের সমাজে দেনমোহর এর অযুহাতে বিয়েকে কঠিন করা হয়েছে অথচ ইসলামে বিয়েকে সহজ করা হয়েছে
পৃথিবীর ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার অন্যতম এক উপাদান বিয়ে। চারিত্রিক নিষ্কলুষতা টিকিয়ে রাখার উপায়ও এই বিয়ে। হাদিসের ভাষায়, বিয়েতে রয়েছে নানামুখী বরকত। এটি লজ্জাস্থান ও দৃষ্টি হেফাজতের সর্বোত্তম পন্থা। তবে বিয়ের বহুবিধ কল্যাণ থাকলেও বর্তমানে বিষয়টিকে কঠিন করে তোলা হয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে।
অভাব ও দারিদ্র্যের ভয়ে বিয়ের প্রতি যুবকদের একটি নীরব অনীহা ও শংকা সৃষ্টি হচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির পেছনে আমাদের সমাজ অনেকাংশে দায়ী। অথচ হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দারিদ্র্যের ভয়ে বিয়ে থেকে বিমুখ থাকলো, সে যেন আল্লাহর ব্যাপারেই মন্দ ধারণা পোষণ করলো।’ –সুনানে আবু দাউদ
আমাদের সমাজের যুবক শ্রেণি- পড়াশুনা, ক্যারিয়ার ও দারিদ্র্যের শঙ্কায় চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে বিয়ে থেকে বিমুখ থাকছে। ফলশ্রুতিতে সমাজে অবৈধ সম্পর্ক, অনাচার, চরিত্র বিধ্বংসী নানা কার্যকলাপ বিকাশ লাভের সুযোগ অবারিত হচ্ছে। অথচ বিয়ের সহজীকরণের ব্যাপারে খোদ আল্লাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা, ‘যদি তারা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তাদের স্বাবলম্বী বানিয়ে দেবেন।’ -সূরা নূর: ৩২
বর্তমান সময় যুবকদের বিয়ে করতে গিয়ে সর্বপ্রথম যে বাধার সম্মুখীন হন সেটা হল দেনমোহর,
দেনমোহর হলো স্ত্রীর প্রতি সম্মানসূচক স্বামীর একটি আবশ্যিক দেনা। মুসলিম আইন অনুযায়ী, দেনমোহর হলো কিছু টাকা বা অন্য কোনো সম্পত্তি যা স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে বিয়ের মূল্যস্বরূপ পাওয়ার অধিকারী হয়। একজন নারীর অধিকারপ্রাপ্তিতে প্রথমেই দেনমোহরপ্রাপ্তির বিষয়টি চলে আসে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে, সন্তুষ্ট চিত্তে তারা মোহরের কিয়দংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করবে।’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত-৪)।
এ ছাড়া কুরআনের আরো এক আয়াতে দেনমোহরের অধিকার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদেরকে, যাদের মোহর তুমি প্রদান করেছো।’ (সুরা আল-আহজাব, আয়াত-৫০)।
দেনমোহর ইসলামে এমন একটি বিষয়, যার মাধ্যমে স্ত্রীর অধিকার পাকাপোক্ত করা হয়। পরিশোধের ভিত্তিতে দেনমোহর দুই ধরনের হয়। যথা- মুয়াজ্জল (আশু) দেনমোহর এবং মু-অজ্জল (বিলম্বিত) দেনমোহর।
আশু দেনমোহর চাওয়ামাত্র পরিশোধ করতে হয়। আর বিলম্বিত দেনমোহর হচ্ছে, দেনমোহরের যে অংশটুকু স্বামীর মৃত্যুর পর, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদ বা তালাকের পর স্ত্রী পেয়ে থাকেন। বিলম্বিত দেন মোহর বিয়ের পর যেকোনো সময় পরিশোধ করা যায়। তবে মৃত্যু বা বিয়ে বিচ্ছেদের পর দেনমোহর অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। তখন দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ হিসেবে থাকে।
প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে, তালাকের কারণে দেনমোহর দিতে হয়। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। দেনমোহর বিয়ের শর্ত। তালাকের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।
বিয়ে বিচ্ছেদ হোক বা না হোক দেনমোহর পরিশোধ করা স্বামীর দায়িত্ব।
বিবাহবিচ্ছেদ বা বিলম্বিত তালাক হয়ে গেলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে কোনো স্ত্রী তাঁর বিলম্বিত দেনমোহর আদায়ের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করে তা আদায় করতে পারেন। তবে তা অবশ্যই তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। স্বামীর মৃত্যু হলে বকেয়া দেনমোহর একটি ঋণের মতো।
এটি শোধ করতেই হয়। স্বামীর উত্তরাধিকারীরা এটি প্রদানে বাধ্য। অন্যথায় মৃত স্বামীর উত্তরাধিকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করে আদায় করা যায়। স্ত্রী যদি আগে মারা যান, তা-ও দেনমোহর মাফ হয় না। স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহর পেতে হকদার। তাঁরাও মামলা করার অধিকার রাখেন।
দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার সংরক্ষণের জন্য এবং স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দেয়া হয়। এটি মূলত স্বামীর ওপর আইনগত আরোপিত একটি দায়। মানুষের মাঝে একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, বিয়ের রাতে স্বামী চাইলে স্ত্রীর কাছ থেকে দেনমোহর মাফ করিয়ে নিতে পারেন, তবে তা মাফ হয়ে যায়। কিন্তু আইন ও আদালতে এ ধরনের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
দেনমোহরের টাকা মাফ করা যায়, তবে সে জন্য কিছু শর্ত আছে। স্ত্রীর পূর্ণ সমর্থন থাকতে হবে এবং কোনো ধরনের প্ররোচিত না হয়ে মাফ করতে হবে। কারও দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার আগেই যদি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হয়, তবে দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করতে হবে।
আমাদের দেশে ১৯৬১ সালে প্রণীত মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন (কাবিননামা) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেখানে বিবাহিত নারীদের দেনমোহরের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। স্বামী সেই দেনমোহর দিতে বাধ্য। এই আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো প্রথমত: যাতে বিবাহের একটি লিখিত দলিল থাকে, দ্বিতীয়ত: যাতে দেনমোহরানার বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত থাকে। দেনমোহরের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নেই।
দেনমোহর বিয়ের সময় বা বিয়ের পরও নির্ধারণ করা যায়। উপযুক্ত দেনমোহর নির্ধারিত হয় বর-কনের পারস্পরিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। এতে উভয়পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতি থাকে। দেনমোহর নির্ধারণ কম বা বেশিতে আইনগত কোনো বাধা নেই, তবে টাকার অংশ স্বামীর আর্থিক সামর্থ্যের মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। দেনমোহর নির্ধারণের সময় সঙ্গতিপূর্ণ দেনমোহর নির্ধারণ করা উচিৎ। শুধু লোক দেখানোর জন্য কোটি টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করা, এরপর, প্রথম রাতেই ৯৯ লক্ষ ৯৯ হাজার টাকা মাফ করিয়ে নেয়া- এগুলো মানবতা বিবর্জিত ঘৃণিত কাজ। অতএব শুধু অঙ্কের দিকে না তাকিয়ে সামর্থ্যের দিকেও তাকানো উচিৎ। দেনমোহরের পরিমাণ এতো বেশি নির্ধারণ করা উচিত নয় যা স্বামীর পক্ষে দেয়া অসম্ভব। কম মোহরানা নির্ধারণ কোনো সম্মানহানীর বিষয় নয়। আবার মোটা অঙ্ক নির্ধারণও কোনো গর্বের বিষয় নয়। বরের সামর্থ্যের বাইরে অতিরিক্ত মোহরানা দাবী করার আগে ভেবে দেখুন, নিজ পরিবারের নারীকে বিয়ে দিচ্ছেন, গরু ছাগলকে নয়।
স্বামী বা স্বামীর পরিবার উপহার হিসেবে স্ত্রীকে যা দেবে তা অবশ্যই দেনমোহর নয়। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে অনেক কিছুই দিতে পারেন। স্বামী যদি দেনমোহর হিসেবে স্ত্রীকে দেন, তবেই তা দেনমোহর বলে বিবেচিত হবে।
কিছু বরপক্ষ আছেন, যারা উপহার সামগ্রী দিয়ে দেনমোহর পরিশোধ করার পর বিভিন্ন জনের কাছে বলে বেড়ায় "মেয়েকে আমরা এতো ভরি স্বর্ণ দিয়েছি" কিংবা "ফ্ল্যাটবাড়ি বা জমি দিলাম"। যেন সেগুলো দেনমোহর হিসাবে দেয়নি, অতিরিক্ত দিয়েছে।
এক্ষেত্রে বিয়ের সময় গহনা, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে উসুল লিখে নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, গহনা, শাড়ির মূল্য ধরে নিকাহনামার সংশ্লিষ্ট ধারায় উসুল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলেই তা দেনমোহরের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে যেভাবেই, যতোটুকু পরিমাণে দেয়া হোক না কেন প্রত্যেক মেয়ের উচিত তার দেনমোহর নামক অধিকার বিষয়ে সচেতন হওয়া।
আল্লাহ তায়ালা সকলকে বুঝার তৌফিক দান করুন,
বিয়ে নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে পর্ব চলবে ইনশাআল্লাহ
Post a Comment