(বর্তমান সমাজের ঘটে চলা পারিবারিক ঘটনা নিয়ে অসাধারণ শিক্ষামূলক একটি কল্পিত কাহিনী)
■■ অফিসে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে মা আমায় ডেকে বললেনঃ
-------"তোর বউয়ের তো সাতমাস চলছে। তা বউমাকে কবে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবি?"
■▪আমি কিছুটা অবাক হয়ে মাকে বললামঃ
--------"ঠিক বুঝলাম না মা! এই অবস্থায় শ্রাবণীকে (আমার বউ এর নাম) বাপের বাড়ি দিয়ে আসবো কেন?"
●▪মা তখন বললেনঃ
-------"দেখ! আমাদের বংশের একটা নিয়ম হলো বাড়ির বউয়ের প্রথম সন্তান তাদের বাপের বাড়ি হয়। প্রথমবার বাচ্চার মা হবে। বলা তো যায় না, কখন কি হয়! কিছু একটা হলে দেখা যাবে, এর জন্য তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের দায়ী করবে!"
■▪আমি মাকে বললামঃ
--------"মা! তুমি তো জানোই আমার শ্বশুরবাড়ি গ্রামে। তাছাড়া ওদের বাসা থেকে হাসপাতাল-ক্লিনিক অনেক দূরে। আল্লাহ না করুন, দেখা গেলো শ্রাবণীর কোন সমস্যা হলে ওরা সময় মত হাসপাতালেই নিয়ে যেতে পারবে না। তারচেয়ে শ্রাবণী এইখানেই থাকুক।"
●▪আমার কথা শুনে মা বিরক্ত হয়ে বললেনঃ
-------"জানিস! বাচ্চা হলে কত টাকা খরচ হয়? আজকাল মেয়েরা তো নবাবজাদী হয়ে গেছে। একটু ব্যাথা সহ্য করতে পারে না। তাই ব্যাথা উঠার আগেই পেট কেটে বাচ্চা বের করে ফেলে। তাছাড়া এইসব সিজার করতে অনেক টাকা পয়সা লাগে। তাই আমার কথা মত বউমাকে ওর বাপের বাড়ি দিয়ে আয়। ওদের মেয়ে ওরা এইসব ঝামেলা দেখুক।"
■▪আমি মুচকি হেসে মাকে বললামঃ
-------"শ্রাবণী ওদের বাড়ির মেয়ে হলেও সে এখন আমার স্ত্রী এবং আমার অনাগত সন্তানের মা। তাই ওদের থেকে আমার দায়িত্ব আর কর্তব্যটা অনেক বেশি। মা! আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম। আর কয়েকটা টাকা পয়সার জন্য আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবো না"---
এই কথা বলে আমি যখন মা'র রুম থেকে বের হলাম। তখন খেয়াল করি শ্রাবণী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে।
●▪আমায় দেখে শ্রাবণী শুকনো হাসি হেসে বললোঃ
-------"পিয়াস! আল্লাহর রহমতে আমার কিছু হবে না। তুমি আমায় আমার বাপের বাড়ি দিয়ে এসো।"
■▪শ্রাবণীর শুকনো হাসির পিছনে কতটা কষ্ট আর অভিমান জমা ছিলো, সেটা আমি ঠিকমতই বুঝতে পেরেছিলাম। আমি তখন ওর হাতটা ধরে বললামঃ
-------"তোমার মুখে শুকনো হাসি মানায় না! সতেজ হাসিটা বেশি মানায়। চিন্তা করো না আমি আছি তো তোমার পাশে......!"
■■ অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বিকাল পাঁচটা বেজে গেলো। আমি তড়িঘড়ি করে বাসায় ঢুকে শ্রাবণীকে বললামঃ
-------"তুমি তৈরি হয়ে নাও তো, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।"
●▪শ্রাবণী তখন বললোঃ
-------"আমি ঠিক আছি তো! শুধু শুধু ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না!"
■▪শ্রাবণীর কথা শুনে আমি কিছুটা রেগে গিয়ে বললামঃ
-------"তোমার এত বুঝতে হবে না। ডাক্তার বলেছিলেন পনেরো দিন পর পর একবার চেকাপ করাতে। আর আজ ১৭ দিন চলছে! যাও জলদি তৈরি হয়ে আসো।"
■■ শ্রাবণীকে নিয়ে বাসা থেকে বের হবার সময় মা আমাদের দেখে বললেনঃ
-------"তোদের ঢং দেখে আর বাঁচি না। আমিও দুই সন্তানের মা হয়েছি! তোদের মতো আমাকে কখনো দুইদিন পর পর ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হয়নি!"
■▪মা'র কথা শুনে আমি তাঁর কথার কোন জবাব না দিয়ে হেসে বললামঃ
-------"মা! দরজাটা লাগিয়ে দাও। আমাদের আসতে এক ঘন্টার মত দেরি হবে.....!"
■■ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে যখন বসে ছিলাম, হঠাৎই তখন খেয়াল করে দেখি শ্রাবণী মাথা নিচু করে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। আমি তখন ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললামঃ
-------"প্লিজ! মা'র কথায় কিছু মনে করো না। সেকালের মানুষ। তাই এত কিছু বুঝেন না! আমি আছি তো সব সময়ই তোমার পাশে......"
■■ অফিসের বস আমার দেওয়া এপ্লিকেশনটা হাতে নিয়ে বেশ কয়েকবার পড়ে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেনঃ
-------"বাচ্চা হবে আপনার স্ত্রীর! আর এখানে আপনি ছুটি চাইছেন একমাসের! আসল ব্যাপারটা কি?"
■▪আমি বসকে বললামঃ
-------"স্যার! আমি এখন থেকে পুরোটা সময় আমার স্ত্রীর পাশে থাকতে চাই।"
●▪বস কিছুটা অবাক হয়ে বললেনঃ
-------"তাই বলে দীর্ঘ এক মাসের ছুটি আমি আপনাকে কিভাবে দিবো? আপনি মহিলা হলে আপনাকে না হয় গর্ভকালীন ছুটি দেওয়া যেতো! কিন্তু আপনি তো আর মহিলা নন, পুরুষ! আপনাকে কিভাবে এত দিনের ছুটি দেই?"
■▪আমি বসকে তখন বললামঃ
-------"গর্ভকালীন ছুটিটা একজন গর্ভবতী মহিলার পাশাপাশি একজন পুরুষেরও সেটা প্রাপ্য। প্রতিটা পুরুষের দায়িত্ব স্ত্রীর গর্ভকালীন এইসময়ে স্ত্রীর পাশে থাকা। তেমনি প্রতিটা স্ত্রীও চায় এই সময়টাতে তার স্বামী যেন তার পাশে থাকে। গত ছ'বছর চাকরি করে এই কোম্পানিকে আমি অনেক কিছু দিয়েছি! আমার এই প্রয়োজনীয় মূহুর্তে কোম্পানি কি আমায় এখন মাত্র এক মাস সময় দিতে পারে না? আমি তো বেশি কিছু চাইনি!"
●▪বস আমার কথাগুলো চুপচাপ শুনে বললেনঃ
-------"ঠিক আছে। আপনি যান, আমি বিষয়টা দেখছি!"
■■ কয়েকদিন হলো বড় আপা আমাদের বাসায় এসেছেন। আমি অদ্ভুতভাবে খেয়াল করে দেখছি, বড় আপার যে কাজ গুলো নিজের করা উচিত, সেই কাজ গুলো শ্রাবণীকে দিয়ে করাচ্ছেন! সেদিন খেয়াল করে দেখি, বড় আপা একমনে টিভিতে সিরিয়াল দেখছেন আর শ্রাবণীকে বলছেনঃ
-------"আমার বাচ্চার দুধটা একটু গরম করে দাও তো।"
■▪︎আরেকদিন শুনি বড় আপা বিছানায় শুয়ে থেকে শ্রাবণীকে ডেকে বলছেনঃ
-------"আমার মাথাটা খুব ব্যাথা করছে। আমায় এক্ষুণি এককাপ কড়া করে কফি বানিয়ে দাও তো!"
■■ আজ সকাল থেকেই শ্রাবণীরর শরীরটা একটু খারাপ। এই অবস্থায় বড় আপা শ্রাবণীকে বললেনঃ
-------"তোমার হাতের তৈরি পাটিসাপটা পিঠা তোমার দুলাভাই খেতে খুব পছন্দ করেন৷ তুমি আজ আমায় কতগুলো পাটিসাপটা পিঠা বানিয়ে দিও তো।"
■▪আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম আমার বড় বোনের কথা শুনে! তাই কিছুটা রেগে গিয়ে তাকে বললামঃ
-------"তোর জামাইকে তুই নিজে পিঠা বানিয়ে খাওয়া। তুই আমার বউকে বলছিস কেন?"
●▪বড় আপা তখন মুখ বাঁকিয়ে বললোঃ
-------"বউয়ের চামচামি করছিস নাকি?"
■▪আমি বললামঃ
-------"আমি কোন চামচামি করছি না! শুধু তোর মত একটা শিক্ষিত মেয়ের ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছি! তুই নিজেও একবাচ্চার মা। তুই তো বুঝিস এই সময় একটা মেয়ের কত রকম সমস্যা হয়৷ তুই কি করে এই অবস্থায় আমার বউকে বলিস তোর বাচ্চার দুধ গরম করে দিতে, তোর জন্য কফি বানিয়ে দিতে, আর আজ বলছিস তোর জামাইয়ের জন্য পিঠা বানাতে? মেয়েটা প্রথমবার মা হচ্ছে। মনে কত রকমের ভয় থাকতে পারে। কোথায় তুই শ্রাবণীকে একটু সাহায্য করবি, একটু মনে সাহস দিবি যেন সে ভয় না পায়। তা না করে উল্টো তুই ওকে পিঠা বানাতে বলছিস!"
●▪আমার কথা শুনে এমন সময় মা খুব রেগে গিয়ে বললেনঃ
-------"আমি এমন ছেলে পেটে ধরেছি যে কিনা নিজের বউয়ের জন্য নিজের বড় বোনকে কথা শোনাচ্ছে! কি এমন তোর বউকে বলেছে যে, তুই তোর বোনকে কথা শোনাচ্ছিস? মাত্র তো কয়েকটা পিঠা বানিয়ে দিতেই বলেছে। অথচ তোরা যখন আমার পেটে ছিলি তখন আমি সংসারের সমস্ত কাজ একা হাতে করতাম!"
■▪আমি মা'র দিকে তাকিয়ে হেসে বললামঃ
-------"মা! আমার বোন যখন প্রেগন্যান্ট ছিলো, তখন তুমি পাঁচ মাস যেতে না যেতেই আপাকে শ্বাশুরবাড়ি থেকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলে, যাতে আপার ওখানে সংসারের কোন কাজ করতে না হয়। আমি দেখেছি আপাকে দিয়ে তুমি কাজ করানো তো দূরে থাক আপাকে কখনোই রান্নাঘরে পর্যন্ত যেতে দাও নি! সেই তুমিই তোমার একমাত্র ছেলের বউয়ের বেলায় এতটা বদলে গেলে.....!"
■■ আমি যখন মা আর আপার সাথে কথাগুলো বলছিলাম তখন শ্রাবণী আমাকে বারবার থামতে বলছিলো। তখন আপা শ্রাবণীকে বললোঃ
-------"থাক! থাক! নিজের স্বামীকে মা-বোনের উপর খেপিয়ে দিয়ে এখন আমাদের চোখে ভালো সাজতে হবে না!"
●▪কথাটা শুনে শ্রাবণী মাথা নিচু করে অন্য রুমে চলে গেলো। আমি তখন আপার দিকে তাকিয়ে বললামঃ
-------"মূর্খ মানুষ অবুঝ হলে তাকে বুঝানো সহজ। কিন্তু কোন শিক্ষিত মানুষ অবুঝ হলে তাকে বুঝানো সত্যিই খুব কঠিন!"
■■ রুমে ঢুকে দেখি শ্রাবণী জানালার গ্রীল ধরে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললামঃ
-------"চিন্তা করো না, আমি আছি তো তোমার পাশে..."
●▪শ্রাবণী আমার দিকে ফিরে শুকনো হাসি দিলো। আর আমি তখন বললামঃ
-------"তোমার মুখে শুকনো হাসি মানায় না, সতেজ হাসিটা বেশি মানায়!"
■■ Moral:-
বর্তমান সমাজের অধিকাংশ পরিবারেই এধরণের ঘটনা ঘটছে! যা সত্যিই অমানবিক! একটা বিবাহিত মেয়ের ভরসার সবচেয়ে বড় অবলম্বন হলো তার স্বামী। তাই প্রতিটি পুরুষ যদি তার বউ এর প্রতি এমন ভাবে কিংবা সঠিক ও পরিপূর্ণ ভাবে দায়িত্বশীল হন, তাহলে কোনো মেয়েকেই আর কষ্ট পেতে হবে না! আর পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন হবে সুখ, সম্মৃদ্ধ এবং আনন্দময়! মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল এবং হিফাযত করুন (আ-মীন)।।
Post a Comment