১০ মুহাররম পবিত্র আশুরার রোজা ও ফজিলত, এবং কারবালার সঠিক ইতিহাস জেনে নিন


আসসালামু আলাইকুম, আশাকরি আল্লাহর রহমতে সকলেই ভালো আছেন, কওমী কলমের সকল পাঠকদেরকে নতুন বৎসরের শুভেচ্ছা, ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুসারে আমরা ১৪৪৫ হিঃ এর নতুন বছর শুরু করতেছি, নতুনের মধ্যে আমরা পরিবর্তনের আশা ও কামনা অনুভব করে আনন্দিত হয়, তবে আমাদের বুঝতে হবে মানুষের প্রতিটি দিনই নবজীবন, সুন্দর হোক সকলের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত। 

প্রিয় পাঠক, মুহাররম মাস ইসলামি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাস সমুহের মধ্যে একটি, এই মাসের অনেক গুরুত্ব ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

মুহাররম মাস হারাম মাস গুলির অন্যতম। ইসলামি শরীয়তে যুলক্বদ-যুলহজ্ব-মুহাররম ও রজব এ চারটি মাসকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে এগুলি হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ বা সম্মানী মাস বলে পরিচিত,এসকল মাসে সকাল প্রকার পাপ অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে ও অধিক পরিমানে নেক আমল করতে নির্দেশ করা হয়েছে কোরআন হাদিসে।

এ মাস গুলোর মাঝে অন্যতম হলো মুহাররম মাস, এ মাসকে আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে হাদিসে, এ মাসে নফল রোজার সওয়াব অন্যান্য মাসের রোজার সওয়াবের চেয়ে বেশী। 

রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, 

افضل الصيام بعد شهر رمضان صيام شهر الله المحرم

রমাদানের পরে সবচেয়ে বেশি ফজিলতের সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহাররমের সিয়াম, ( মুসলিম - ২/৮৬১)

মুহাররম মাসের দশ তারিখকে আশুরা বলা হয়, বিশেষ ভাবে এ দিনটিতে রোজা রাখতে উৎসাহ ও নির্দেশনা দিয়েছেন রাসুল সাঃ।

আশুরার রোজা কবে থেকে মুসলমানরা পালন করে? 

জাহেলি যুগে এ দিনটিতে মক্কার মানুষেরা আশুরার রোজা রাখতো এবং সেদিন কাবার গিলাফ পরিবর্তন করতো, হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবস্থান কালে রাসূল সাঃ নিজেও রাখতেন,,  

আশুরার দিনে কারবালার মর্মান্তিক ঘটানা সহ আরো অনেক ঘঠনা রয়েছে, আশুরার ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় ঘটনার শীর্ষে স্থান পায় মুসা (আ.)-এর একটি ঘটনা। এই দিনে তিনি অত্যাচারী শাসক ফিরাউনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।

মহাপরাক্রমশালী প্রভু আল্লাহ পাক সেদিন চিরকালের জন্য নীল নদে ডুবিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন ভ্রান্ত খোদা দাবিদার ফিরাউন ও তার বিশাল বাহিনীকে।

এ ঘটনার বিবরণে ইমাম বুখারি (রহ.) সাহাবি হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘মহানবী (সা.) হিজরত করে মদিনায় পৌঁছে মদিনার ইহুদিদের আশুরার দিনে রোজা পালন করতে দেখেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করেন, এই দিনে কী ঘটেছে যে তোমরা এতে রোজা পালন করো? তারা বলে, এই দিনটি অনেক বড় দিন, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ফিরাউন থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং ফিরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। এর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মুসা রোজা রাখতেন, তাই আমরাও আশুরার রোজা পালন করে থাকি। ইহুদিদের জবাব শুনে রাসুলে করিম (সা.) বলেন, মুসা (আ.)-এর কৃতজ্ঞতার অনুসরণে আমরা তাদের চেয়ে বেশি যত্নশীল হওয়ার অধিকারী।

অতঃপর তিনি নিজেও আশুরার রোজা রাখেন এবং মুসলমানদের তা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৩৯৭, মুসলিম, হাদিস : ১১৩৯)

রমদানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশুরার রোজা ফরজ ছিলো, অতপর রমজনের রোজা ফরজ হওয়ার পরে আশুরার রোজ মুস্তাহাব পর্যায়ে ঐচ্ছিক ইবাদতে গন্য হয়, তা পালন না করলে কোন গোনাহ হবেনা, আর পালন করলে রয়েছে অফুরন্ত সওয়াব,

রাসুল সাঃ বলেন.. 

صيام يوم عاشوراء، أحتسب على اللَّه أن يكفر السنة التي قبله" 

শি আশা করি আশুরার রোজার কারনে আল্লাহ তায়ালা পূর্ববর্তী ঘুনাহের কাফফারা করে দিবেন। (মুসলিম -২/৮১৭)

আশুরায় দুই রোজার কারণ : 

আশুরায় দুই রোজা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেন। এক হাদিসে আছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে, আশুরার আগে বা পরে আরও একদিন রোজা রাখো’। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১/২৪১) 

আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই রোজা বিগত বছরের গুনাহ মুছে দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ১১৬২)

মুসলিম শরিফে ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল, বিধর্মীরা তো এই দিনটিকে বড় দিন মনে করে। এই দিনে তারাও রোজা পালন করে। আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি তাহলে তো এদের সঙ্গে সামঞ্জস্য হবে। তাদের প্রশ্নের জবাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন (তারা যেহেতু এদিন একটি রোজা পালন করে), আগত বছর ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব, ইনশাআল্লাহ। (মুসলিম, হাদিস : ১১৩৪)

অন্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো, তবে এ ক্ষেত্রে ইহুদিদের সঙ্গে মিল না হওয়ার জন্য ১০ তারিখের আগের দিন অথবা পরের দিন আরো একটি রোজা রেখে নিয়ো।' (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৫৪)

উপরোক্ত হাদিসগুলোর আলোকে প্রমাণিত হয় যে আশুরার রোজা হবে দুটি—মহররমের ১০ তারিখ একটি, আর ৯ তারিখ অথবা ১১ তারিখ আরো একটি।

হাদিস রেফারেন্স, মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানী-এর 'আশুরার তাৎপর্য ও করণীয়' শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। 

এবছর আশুরার রোজা হলোঃ 

২৯ জুলাই শনিবার ১০ এ মুহাররম, তাই আশুরার রোজা রাখতে হবে শুক্রবার,শনিবার অথবা শনিবার,রবিবার।

মোট কথা দুইদিন রোজা রাখতে হবে. 

মুহাররম মাসের ৯, ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখা উত্তম (২৮-৩০ জুলাই)। আশুরার দিন (১০ মুহাররম) রোজা রাখলে আগের ও পরের ২ বছরের গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।

এছাড়াও আমরা সকলে চেষ্টা করব মুহাররম মাসের আইয়ামে বীজের ৩ টি রোজা রাখার। এ মাসের আইয়ামে বীজের রোজা রাখতে হবে ১, ২ ও ৩ আগস্ট ২০২৩ এই তিনদিন।

আল্লাহ আমাদেরকে মুহাররম মাসের মর্যাদা রক্ষা করে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।

প্রিয় পাঠক এটা ছাড়াও অন্য একটি কারণে আশুরার রোজা মুসলিম উম্মাহর মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তা হলো কারবালার ঘটনা,অনেকে আশুরা বলতে কারবালার ঘটনাকেই বুঝেন৷  

যদিও ইসলামি শরীয়তে আশুরার রোজা ও ফজিলতের সাথে কারবালার ঘটনার সাথে কোন সম্পর্ক নাই, তবে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে কারবালার সঠিক ঘটনা সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার,  

বর্তমানে কারবালার ঘটনার নামে বিভিন্ন বানোয়াট ইতিহাস,ঘটনা লোক মুখে প্রচিলত রয়েছে, যা মূল ঘটনার সাথে সম্পুর্ন বিপরীত,

কারবালার সঠিক ইতিহাস না জানার কারনে মানুষও সে গুলোকে বিশ্বাস করে নিচ্ছে, চলুন কারবালার সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানি, 

কারবালার ঘটনা মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত হৃদয় বিদারক বেদনাদায়ক। 

রাসূল সাঃ এর ওফাতের মাত্র ৫০ বছর পরে ৬১ হিজরী সালের মুহাররমের ১০ তারিখ শুক্রবার ইরাকের কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে শহিদ হোন তাঁরই প্রিয়তম দৌহিত্র হুসাইন ইবনে আলী রাঃ। 

এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মাঝে চিরস্থায়ী বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে.. অনেক মিথ্যা ভিত্তিহীন কাহিনি মুসলিম সমাজে প্রচলিত রয়েছে, যে গুলো বিস্তারিত আলোচনা এই পোস্টে করা সম্ভব না,  

তবে পাঠাকদের সঠিক ইতিহাস জানার জন্য ডঃ আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহঃ এর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ খুৎবাতুল ইসলাম বই এর কয়েকটি কপি আপলোড করা হলো,,  

সম্পূর্ণ ঘটনা লিখকে আর্টিকেল অনেক লম্বা হয়ে যাবে, তাই ছবিতে ক্লিক করে Full Display Zoom করে পড়ে নিন





আশুরায় অতীত ও ভবিষ্যত ঘটনাবলির বানোয়াট ফিরিস্তিঃ
মিথ্যাবাদীরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নামে জালিয়াতি করে বলেছে:
  1. আশুরার দিনে আল্লাহ আসমান ও যমিন সৃষ্টি করেছেন।
  2. এ দিনে তিনি পাহাড়, পর্বত, নদনদী.... সৃষ্টি করেছেন।
  3. এ দিনে তিনি কলম সৃষ্টি করেছেন।
  4. এ দিনে তিনি লাওহে মাহফূয সৃষ্টি করেছেন।
  5. এ দিনে তিনি আরশ সৃষ্টি করেছেন।
  6. এ দিনে তিনি আরশের উপরে সমাসীন হয়েছেন।
  7. এ দিনে তিনি কুরসী সৃষ্টি করেছেন।
  8. এ দিনে তিনি জান্নাত সৃষ্টি করেছেন।
  9. এ দিনে তিনি জিবরাঈলকে (আঃ) সৃষ্টি করেছেন।
  10. এ দিনে তিনি ফিরিশতাগণকে সৃষ্টি করেছেন।
  11. এ দিনে তিনি আদমকে (আঃ) সৃষ্টি করেছেন।
  12. এ দিনে তিনি আদমকে (আঃ) জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
  13. এ দিনে তিনি ইদরীসকে (আঃ) আসমানে উঠিয়ে নেন।
  14. এ দিনে তিনি নূহ (আঃ)-কে নৌকা থেকে বের করেন।
  15. এ দিনে তিনি দায়ূদের (আঃ) তাওবা কবুল করেছেন।
  16. এ দিনে তিনি সুলাইমান (আঃ)-কে রাজত্ব প্রদান করেছেন।
  17. এ দিনে তিনি আইঊব (আঃ)-এর বিপদ-মসিবত দূর করেন।
  18. এ দিনে তিনি তাওরাত নাযিল করেন।
  19. এ দিনে ইবরাহীম (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন... খলীল উপাধি লাভ করেন।
  20. এ দিনে ইবরাহীম (আঃ) নমরূদের অগ্নিকুন্ডু থেকে রক্ষা পান।
  21. এ দিনে ইসমাঈল (আঃ) কে কুরবানী করা হয়েছিল।
  22. এ দিনে ইউনূস (আঃ) মাছের পেট থেকে বাহির হন।
  23. এ দিনে আল্লাহ ইউসূফকে (আঃ) জেলখানা থেকে বের করেন।
  24. এ দিনে ইয়াকুব (আঃ) দৃষ্টি শক্তি ফিরে পান।
  25. এ দিনে ইয়াকূব (আঃ) ইউসূফের (আঃ) সাথে সম্মিলিত হন।
  26. এ দিনে মুহাম্মাদ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেছেন।
  27. এ দিনে কেয়ামত সংঘঠিত হবে....।
কেউ কেউ বানিয়েছে: মুহার্রামের ২ তারিখে নূহ (আঃ) প্লাবন হতে মুক্তি পেয়েছেন, ৩ তারিখে ইদরীসকে (আঃ) আসমানে উঠানো হয়েছে, ৪ তারিখে ইবরাহীমকে (আঃ) অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এরূপ অগণিত ঘটনা এ মাসে বা এ দিনে ঘটেছে এবং ঘটবে বলে উল্লেখ করেছে জালিয়াতরা তাদের এ সকল কল্প কাহিনীতে। মোট কথা হলো, আশুরার দিনে মূসা (আঃ) ও তাঁর সাথীদের মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো ঘটনা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। 
আদমের (আঃ) এর তাওবা কবুল, নূহ (আঃ) এর নৌকা জূদী পর্বতের উপর থামা ও ঈসা (আঃ) জন্মগ্রহণ করার কথা অনির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে বর্ণিত। আশুরা বা মুহার্রাম সম্পর্কে আর যা কিছু বলা হয় সবই মিথ্যা ও বাতিল কথা। দুঃখজনক হলো, আমাদের সমাজে মুহার্রাম বা আশূরা বিষয়ক বই পুস্তকে, আলোচনা ও ওয়াযে এ সমস্ত ভিত্তিহীন কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়।

রেফারেন্স: ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১১২-১১৭; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানার, পৃ. ৫২; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ২/১৯০; ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ২/১৬৯; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১০৮-১০৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৪৯; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ. ৩০০; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৯৪-৯৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৭৭-২৭৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫৫৭।

Post a Comment

Previous Post Next Post
icon যে কোন প্রয়োজনে টেলিগ্রাম চ্যানেলে মেসেজ দিন