চীনে নির্যাতিত উইঘুর মুসলিমদের খোঁজ নেওয়ার মতো কেউ নেই, কেমন আছে উইঘুর মুসলিমরা?

চীন, নামটা শুনা মাত্র আপনার মনে সর্বপ্রথম কোন বিষয় টা ভেসে উঠে?বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার?চতুর্থ বৃহওম দেশ,জনসংখ্যায় সবচে বড় দেশ,নাকি সস্তা পণ্যের দেশ, কোন টা?

যারা একটু খবরাখবর রাখেন বিশ্ব পরিস্থিতির তারা হয়ত এসবের সাথে যোগ করে আরো বলবেন যে চীন মুসলমানের বন্ধু ও বটে,সম্প্রতি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা র পক্ষে থাকার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে।বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ গুলো কে সহায়তা করছে ঋণ দিয়ে।

সবই ঠিক তাহলে? 

হুম বলছি, তার আগে চলুন ঘুড়ে আসি ইতিহাসের রাজপথ হেটে ৯৬ হিজরী থেকে। দিগ্বিজয়ী মুসলিম সেনানায়ক কোতায়বা বিন মুসলিম কাশগড়ে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন।সে সময় থেকে পূর্ব তুর্কমিনিস্তান  উসমানি সলতানাতের অধিনে ছিলো।তুর্কি সালতানাতের পতন অবধি পূর্ব-তুর্কিস্তান তুর্কিদের শাসনাধীনেই ছিলো। তারপর গেলো শতাব্দীর চল্লিশের দশকে এক গৃহবিবাদের সুযোগে মুসলিম অধ্যুষিত বিশাল এই অঞ্চলটি চীন দখল করে নেয়।এ অঞ্চলটাই বাস করে উইঘুর সম্প্রদায়।যারা জাতিতে মুসলিম  উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। মূলত, এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চতুর্পাশ্বে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান।  

সাল ১৯১১। মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়েছে।পূর্ব-তুর্কিস্তানের সংখ্যাগুরু উইঘোর মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে জারি করা হয় নানা কিসিমের নিষেধাজ্ঞা। চীন যে-বছর পুর্ব-তুর্কিস্তান অধিকার করলো, তার পরের বছরই কাশগড়সহ এই ভূখণ্ডের মুসলিম নেতারা ‘পুর্ব-তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র’ নাম দিয়ে এখানকার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য স্বতন্ত্র একটি জাতীয় সঙ্গীত এবং চাঁদ-তারা খচিত পতাকাও তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু চীনা সেনাবাহিনী সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে তাদের এই স্বপ্ন-সাধ চুরমার করে দেয়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও সাধারণ উইঘোরদের উপর চালায় নির্যাতনের স্টিম রোলার।

১৯৬৬ থেকে ৭৬ ইংরেজির মধ্যকার সময়টাতে চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই সময়টাতে পূর্ব-তুর্কিস্তানে সবধরনের ধর্মীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে দেয় চীন। তালা লাগিয়ে দেয় অসংখ্য মসজিদ-মাদরাসায়। জাতিসংঘের একটি কমিটি জানতে পেরেছে যে ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি শিবিরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব ক্যাম্পে তাদের 'নতুন করে শিক্ষা' দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বেইজিং সরকারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বিবিসি জানিয়েছে, একইসঙ্গে শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী লোকজনের ওপর চীন সরকারের নিপীড়নমূলক নজরদারির তথ্যপ্রমাণ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, যেসব লোকজনের ২৬টি তথাকথিত 'স্পর্শকাতর দেশের' আত্মীয়স্বজন আছেন তাদের এসব ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান এবং তুরস্কসহ আরো কিছু দেশ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, এ ছাড়াও যারা মেসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিদেশের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তাদের টার্গেট করেছে কর্তৃপক্ষ। মানবাধিকার সংগঠনগুলো আরো বলছে, এসব ক্যাম্পে যাদের রাখা হয়েছে তাদের চীনা ম্যান্ডারিন ভাষা শেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অনুগত থাকতে। আরো বলা হচ্ছে, তাদের নিজেদের ধর্মীয়া বিশ্বাসের সমালোচনা করতে অথবা সেই ধর্ম পরিত্যাগ করতে।

শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিকভাবেও পর্যুদস্ত করতে থাকে উইঘোর মুসলমানদেরকে। নির্যাতনের সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। বরং দিনদিন বাড়ছে এই পাশবিকতা। চিন্তা করা যায়, চীনা আইনে একজন চীনা যুবক ফ্যাশনের জন্য দাঁড়ি রাখলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু একজন মুসলমান কোনো অবস্থাতেই দাঁড়ি রাখতে পারবে না! দাঁড়ি রাখলে ছয় বছরের কারাদণ্ড! মুসলিম মেয়েরা বোরকা তো দূর কি বাত, মাথায় হিজাবটা পর্যন্ত পরতে পারবে না। এই তো কিছুদিন আগে এই আইন লঙ্ঘনের কারণে এক উইঘোর দম্পতিকে ছয়বছরের কারদণ্ড দিলো চীনের এক আদালত।

অফিস-আদালতে যারা চাকরি-বাকরি করবে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করবে, রমজানের দিনে তারা রোজা রাখতে পারবে না। আটারো বছরের নিচের কেউ জামাতে নামাজ পড়তে পারবে না। এই হলো আধুনিক চীনের অত্যাধুনিক আইন!

এতো কিছুর পরও উইঘোরদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেমে নেই। ১৯৯০ ইংরেজিতে স্বাধীনতার জন্য উইঘোররা ব্যাপকভাবে আন্দোলন গড়ে তুললে চীনা সেনাবাহিনী ৫০ জন স্বাধীনতাকামীকে নির্বিচারে হত্যা করে আন্দোলনকে সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে। কয়েক বছর পর সাতানব্বইতে উইঘোররা স্বাধীনতার জন্য আবারও মাথা উঁচু করলে চীনা প্রশাসন প্রায় দুইশো জন স্বাধীনতাকামীকে গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে পুরো পূর্ব-তুর্কিস্তান জুড়ে। চীনা সরকার বড়ো নির্দয় এবং বর্বরভাবে দমন করে এই আন্দোলন। নির্মমভাবে শহিদ করে দেয় মুক্তিপাগল প্রায় একহাজার মানুশকে। আরো প্রায় চারহাজার উইঘোরকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করে আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে। এমনকি উইঘোর মুসলমানদের ঘর-বাড়িতেও হামলা চালায়। বাজেয়াপ্ত করে প্রচুর ইসলামি বই-পত্র। এরপর থেকে উইঘোরদের স্বাধীনতা আন্দোলন বাহ্যিকভাবে কিছুটা স্তিমিত হলেও ভেতরে ভেতরে তারা আগুন পুষছে সেই আগের মতোই। যে-আগুন একদিন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে। যে-আগুন একদিন পুড়িয়ে ছারখার করবে জালিমের সিংহাসন।

উইঘোর মুসলমানরা যেখানেই যায়, এই আগুন হৃদয়ে করে নিয়ে যায়। এই আগুনের ভেতর লালিত হচ্ছে স্বাধীন একটি ‘উইঘোরিস্তান’-এর স্বপ্ন। যেখানে পতপত করে উড়বে চাঁদ-তারকা খচিত হেলালি নিশান। হেলালি সেই নিশানবরদার উইঘোরিস্তানের রাজধানী কোথায় হবে জানেন? অবশ্যই কাশগড়। কোতায়বা বিন মুসলিমের কাশগড়। আমাদের হারানো ঐতিহ্যের কাশগড়।

বর্তমান উইঘুর জাতির পরিচয়ঃ



মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠী। বর্তমানে উইঘুররা মূলত চীনের শিনচিয়াং অঞ্চলে বসবাস করে। উইঘুররা এই অঞ্চলের সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্যতম। এখানকার ৮০% উইঘুর অঞ্চলের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে তারিম বেসিনে বসবাস করে। জিনজিয়াং এর বাইরে উইঘুরদের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় দক্ষিণ মধ্য হুনান প্রদেশে রয়েছে। চীনের বাইরে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উইঘুর বাস করে। এছাড়া আফগানিস্তান, পাকিস্তান, জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, রাশিয়া, সৌদি আরব, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কে অল্পসংখ্যক উইঘুর রয়েছে।

তথ্য সুত্রঃ উইকিপিডিয়া

Post a Comment

Previous Post Next Post
icon যে কোন প্রয়োজনে টেলিগ্রাম চ্যানেলে মেসেজ দিন