মাঝে স্ত্রীর উচ্চ আওয়াজ দরজার বাইরে থেকে শোনা যায়। মুখ চেপেও সেটা বন্ধ করা দায়! কীভাবে যাবে বলুন? স্বামীর যে খাবার পছন্দ করে, স্ত্রী সেটা রাঁধতে চায় না! রাগে গরগর করতে করতে বলেঃ
"দেখ! আমি নিত্যদিন ওসব রাঁধতে পারব না! যদি চিকেন-ফ্রাই খেতে ইচ্ছে হয়, বাইরে থেকে খেয়ে আসবে! আমাকে আর জ্বালাতন করবে না।”
আবার স্বামীর কথাই ধরুন! তাকেও যদি বলা হয়,
“ভাই সাহেব! কোনদিন বাসায় ফেরার সময় সাথে একটা গোলাপ, এক প্লেট ফুচকা কিংবা একটা আইসক্রিম কিনেছিলেন স্ত্রীর জন্যে?”
অধিকাংশ জনই এর না-সূচক উত্তর দেবেন! অথচ গরিবকে দান করার চেয়েও স্ত্রীকে আইসক্রিম কিনে দেওয়া অধিক সওয়াবের কাজ। এটা আমার বানানো কথা নয় মশাই! স্বয়ং আল্লাহর রসূল ﷺ এমনটাই বলেছেন।
রসূল ﷺ বলেনঃ "আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে এক দিনার ব্যয় করা, একজন দাস মুক্ত করতে এক দিনার ব্যয় করা, গরিব লোককে এক দিনার সাদাকা করা এবং পরিবারের পেছনে এক দিনার ব্যয় করা, এসবের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো, পরিবারের পেছনে এক দিনার ব্যয় করা।” (১)
এবার বিশ্বাস হলো তো? স্ত্রীকে ভালোবেসে তার মুখে খাবার তুলে দেওয়াটাও সাদাকাহ। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন! এটা সাদাকার সওয়াব রাখে।
রাসূল ﷺ বলেছেনঃ "মুমিনকে প্রতিটি কাজের জন্যই প্রতিদান দেওয়া হয়। এমনকি তার স্ত্রীর মুখে খাবারের লুকমা তুলে দেয়ার সময়েও।” (২)
কখনও খাবার তুলে খাইয়ে দিয়েছিলেন তাকে? ওকে খাবার তুলে খাইয়ে দিলে আপনার মান-সম্মান কমে যাবে?
খুব কম স্বামীরাই আজকাল ঘরের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করেন। অনেকেই তো আবার স্ত্রীর সাথে কাজের লোকের মতো আচরণ করেন। দুনিয়ার যত কাজ আছে, সব ওর ওপরেই চাপিয়ে দেন। ঘরের কাজ থেকে শুরু করে আপনার কাপড় ধৌত করা, ইস্ত্রি করা, সব তাকেই করতে হয়। অথচ সে আপনার কাজের লোক নন, জীবনসঙ্গী! তাই দু'জনের কাজগুলো ভাগ করে নিন। সময় পেলে রান্নাঘরে গিয়ে বসুন। খুব ব্যস্ত থাকলে অন্তত এটা বলুনঃ
"তোমার কোনো হেল্প লাগবে?”
মনে মনে হয়তো আমায় গালি দেবেন– “দেখো দেখো! লোকটা কিনা শেষমেশ আমাদের রান্নাঘরে যেতে বলছে! আমরা ওখানে যাব কেন? ওটা নারীদের কাজ। ওদের কাজ ওরাই করুক।” আরে মশাই! সাধে আমি আপনাকে ওখানে যেতে বলিনি। আমার-আপনার প্রিয় রসূল ﷺ নিজেও রান্নাবান্নার কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করেছেন। বিশ্বাস হয় না?
● আসওয়াদ (রাঃ) একবার আয়শা (রাঃ)কে জিজ্ঞেস করলেন, “নাবী ﷺ ঘরে থাকা অবস্থায় কী (কাজ)করতেন?” তিনি বললেনঃ
-------“ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। (পরিবারবর্গের কাজে সহায়তা করতেন)। আর সালাতের সময় হলে সালাতের জন্য চলে যেতেন।” (৩)
বিশ্বাস হলো এবার!? সময় পেলে অবশ্যই আপনি স্ত্রীকে সাহায্য করবেন। ভয় পাবেন না আবার! আপনার স্ত্রী আপনাকে দিয়ে রান্না করিয়ে নেবে না! “কিছু লাগবে?” ----ও আপনার থেকে এতটুকু শুনলেই খুশি! এটুকু বললেই দেখবেন হাসিমুখে বলছে--- “যাও, তোমার কাজ করো। এটা আমার দায়িত্ব, আমাকে পালন করতে দাও।”
টিপসটা একদিন অ্যাপ্লাই করে দেখুন, বিফলে মূল্য ফেরত!
এবার স্ত্রীদের কথা বলি। নয়তো আমাকে আবার ফেমিনিস্ট ভাববেন। অনেক স্ত্রী-কে দেখবেন, সারাদিন নিজের মাথার চুল নিয়ে ব্যস্ত। চুলে কোন শ্যাম্পু লাগাবে! কন্ডিশনার কোন ব্র্যান্ডের হবে! কোন পার্লারে গিয়ে কী কাটিং দেবে এগুলো নিয়ে ঘর মাথায় তুলে ফেলছে! বরের চুলের দিকে তাকানোর ফুরসতও নেই তার! অথচ–রমযান মাসে ইতিকাফে থাকা অবস্থাতেও আয়িশা (রাঃ) রসূল ﷺ এর চুলের যত্ন নিয়েছেন।
উরওয়া(রাঃ) বলেনঃ "আয়শা(রাঃ) ঋতুবতী অবস্থায় রসূলুল্লাহ ﷺ এর চুল আঁচড়ে দিতেন। আর রসূলুল্লাহ ﷺ ই’তিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে তার হুজরার দিকে মাথাটা বাড়িয়ে দিতেন। তখন তিনি মাথার চুল আঁচড়াতেন। অথচ তখন তিনি ছিলেন ঋতুবতী।" (৪)
স্ত্রীদের বলিঃ আপনারা কতদিন স্বামীর মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করেছিলেন? মনে মনে কি? আমায় গালি দিচ্ছেন! দিন, যত পারুন। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি আয়শা(রাঃ) -এর থেকে অনেক বেশি সম্ভ্রান্ত নন যে স্বামীর মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজলে আপনার সম্মান কমে যাবে! বরং এটা করলে আপনাদের মধ্যে ভালোবাসা বাড়বে। আপনার স্বামী আর অন্য মেয়ের দিকে তাকাবেন না!
●আয়শা (রাঃ) বলেছেনঃ “নাবী ﷺ মিসওয়াক করার পর তাঁর মিসওয়াক আমাকে ধৌত করতে দিতেন। অতঃপর আমিণতাঁর ওই মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করে তাঁকে ফেরত দিতাম।” (৫)
আজকাল অনেক ছেলেমেয়েই বিয়ের আগে হা|রাম রিলেশানে জড়ায়। কখনও যদি ওদের দিকে লক্ষ্য করেন তো দেখবেন, তারা একে অপরের সাথে কী পরিমাণ রোম্যান্টিক আরচরণ করে! কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী এ ধরণের রোম্যান্টিসিজম ভুলে যান। অথচ এটা জরুরি। মনে মনে আবার সুফিগিরি দেখিয়ে বলবেন না-- “ওসব কি সূন্নাহ সাপোর্ট করে?”
জি হ্যাঁ! করে। আল্লাহর রসূল সল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও তাঁর স্ত্রীর সাথে রোম্যান্টিক আচরণ করেছেন। তিনি রাতের বেলা স্ত্রীর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন, স্ত্রীর হাতে হাত রেখে নিশিতে হেঁটেছেন, গল্প করেছেন, স্ত্রীকে হালাল কৌতুক শুনিয়েছেন! সুব'হানাল্লাহ!
আয়শা(রাঃ) বলেছেনঃ একবার আমি রসূল ﷺ এর সফরসঙ্গী ছিলাম। তখন আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় তাঁর আগে বেড়ে (জিতে) গেলাম। তারপর যখন আমি স্থূলকায় হয়ে গেলাম, তখন পুনরায় তাঁর সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলাম। তখন তিনি আমার আগে বেড়ে (জিতে) গেলেন। তখন তিনি বললেন, "এটা তোমার আগেরবার জেতার বদলা।” (৬)
যখন বাসার সবাই ঘুমিয়ে যাবে, তখন চুপিচুপি দু'জন ছাদে ওঠুন। নিজেদের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা করুন। দেখুন, কে জেতে! তবে এই প্রতিযোগিতার কোনো রেফারি কিংবা আম্পায়ারের দরকার নেই! আর হ্যাঁ, চাইলে এসময় দু-লাইন কবিতাও আবৃত্তি করতে পারেন,
যবে তাকাই তোমার রুক্ত-জবা ঠোঁটে,
মম হৃদয়খানি বারেবারে শিহরিয়া ওঠে..
যখন কুরআন তিলাওয়াত করবেন, তখন একজন অপরজনকে পাশে নিয়ে বসুন। কোলে মাথা দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করুন। দেখুন, এরপরেও দু'জনের মধ্যে কোনো মনোমালিন্য থাকে কি না?
● আয়শা(রাঃ) বলেছেনঃ "আমার ঋতুকালীন সময়ে রসূল ﷺ আমার কোলে মাথা রেখে কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করতেন।” (৭)
যখন অযু করবেন, তখন এক পাত্র থেকেই দু'জনে পানি নিয়ে অযু করুন।
●আয়শা(রাঃ) বলেছেনঃ "অযু করার সময় আমার হাত ও রসূল ﷺ এর হাত পরস্পর লেগে যেত।” (৮)
আজ তো এই সূন্নাহগুলো হারিয়েই গেছে! দু'জন একই পাত্রে অযু করবে তো দূরের কথা, মাঝেমধ্যে রাগ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, পারলে এক জন আরেক জনের মাথায় গরম পানি ঢেলে দেবে!
দু'জনে একসাথে খেয়েছিলেন কবে, মনে আছে? বিয়ের দিন ছাড়া বোধ হয় একসাথে আর খাওয়া হয়নি! দুপুরে হয়তো দু'জন একসাথে খাওয়ার সময় পান না! কিন্তু রাতে অথবা সকালে তো অসুবিধে নেই। তখন দু'জন একই প্লেটে খান। এক জন আরেক জনের মুখে খাবার তুলে দিন। একটু আগেই একটা হাদীস বলেছিলাম, মনে আছে? হ্যাঁ! মনে রাখবেন। ভুলবেন না যে, একে অপরের মুখে খাবার তুলে দেওয়াটাও সওয়াবের কাজ। আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ হাদীস বলে রাখি,
●●আল্লাহর রসূল ﷺ এর স্ত্রী আয়শা (রাঃ) বলেছেনঃ “আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি পান করতাম এবং পরে নাবী ﷺ কে অবশিষ্টটুকু প্রদান করলে, আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম। তিনিও সেই স্থানেই মুখ লাগিয়ে পান করতেন। আবার আমি ঋতুবতী অবস্থায় হাড় খেয়ে তা নাবী ﷺ কে দিলে, আমি যেখানে মুখ লাগিয়েছিলাম তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে খেতেন।” (৯)
■ এই সূন্নাহটাও ফলো করতে পারেন। আরে মিয়া করেই দেখেন না...! এই সূন্নাহ ফলো করলে দুনিয়াটা একটু বেশিই রঙিন লাগবে! আকাশটা আগের চেয়ে বেশি নীল দেখাবে। মেজাজটা থাকবে ফুরফুরে। না করলে নিজেই পস্তাবেন!
আজকাল রমণীরা তাদের স্বামীর সামনে সাজগোজ করতে চায় না! কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে যান, দেখবেন সাজ কাকে বলে! একেবারে আটা, ময়দা, সুজি কোনোটাই বাকি রাখবে না। আর এমন পারফিউম লাগাবে যে, দেড় মাইল দূর থেকেও তার ঘ্রাণ পাওয়া যাবে! এরাই দেখবেন স্বামীর সামনে একেবারে কাজের বুয়া সেজে বসে থাকবে! অথচ স্ত্রীর সাজগোজ, পারফিউম কেবল বরের জন্যেই! আর বরদের ক্ষেত্রেও একই কথা! এরা মাসল দেখাবে অন্যের রমণীকে! অথচ তার ঘরণীর সামনে একেবারে রিকশাওয়ালার মতো বসে রইবে! কই স্ত্রীর জন্যে স্মার্টনেস শো করবে, তা না! যত স্মার্টনেস, সব যেন অন্যের স্ত্রীর জন্যে!
স্বামী-স্ত্রী হলো একে অন্যের প্রাশান্তির জায়গা। হ্যাঁ! আল্লাহ এমনটাই বলেছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ 'আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।
❒ ফুটনোটঃ
[১] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৯৯৫।
[২] মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং ১৪৮৭।
[৩] সহীহ বুখারি, হাদিস নং ৬৭৬।
[৪] সহীহ বুখারি। আস-সহীহ, হাদিস নং ২৯২।
[৫] আবূ দাঊদ। আস সুনান, হাদিস নং ৫২।
[৬] আবূ দাঊদ। আস-সুনান, হাদিস নং ২৫৭০।
[৭] আবূ দাঊদ। আস-সুনান, হাদিস নং ২৬০।
[৮] আবূ দাঊদ। আস-সুনান, হাদিস নং ৭৮।
[৯] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৯৯।
ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ৬৩৪। আবূ দাঊদ, হাদিস নং ২৫৯।
[১০] সূরাহ আর-রূম, আয়াত : ২১।
●ইয়া আল্লাহ তা‘আলা! আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণ ভাবে সূন্নাত মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদের সবাইকে সুখ ও আনন্দময় উত্তম ও আদর্শ পারিবারিক জীবন দান করুন এবং উত্তম স্বামী/স্ত্রী হিসেবে কবুল করুন(আ-মীন)।।
إرسال تعليق