"রিয়া লোক দেখানো ইবাদত" PDF বই, লৌকিকতা ও রিয়া কি? লোক দেখানো কাজ কিভাবে সওয়াব থেকে বঞ্চিত করে?

"রিয়া" এবং "লৌকিকতা" এই দুই শব্দ ইসলামী ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং কিছুটা মিল থাকা সত্ত্বেও ভিন্ন অর্থ বহন করে।


1. রিয়া (Riya):
   - এটি একটি আরবী শব্দ, যার অর্থ হলো প্রদর্শন বা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কিছু করা। ইসলামে রিয়া হল এমন একটি কর্ম, যেখানে কেউ আল্লাহকে খুশি করার জন্য নয়, বরং মানুষের প্রশংসা পাওয়ার জন্য কাজ করে। যেমন, কেউ নামাজ পড়ছে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন নয়, বরং অন্যদের কাছে নিজেকে ধার্মিক হিসেবে তুলে ধরা। রিয়া ইসলামে নিন্দনীয় এবং এটিকে শিরক (আল্লাহর সাথে অংশীদার করা) হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এতে আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস ও আন্তরিকতা থাকে না।

2. লৌকিকতা (Loukikota):
   - লৌকিকতা বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় সামাজিক আচরণ, আচার-অনুষ্ঠান বা রীতিনীতি, যা মানুষ তাদের সমাজ বা সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পালন করে। এটি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক হতে পারে। লৌকিকতায় মানুষ প্রায়শই সামাজিক সম্মান বা মর্যাদা বজায় রাখতে বা অন্যদের খুশি করার জন্য কাজ করে, যা ধর্মীয় রিয়া থেকে আলাদা। 

উভয়ের ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ। রিয়া ব্যক্তিগত স্তরে ধর্মীয় খোলামেলা কাজের আড়ালে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে চালিত, যেখানে লৌকিকতা সামাজিক বাধ্যবাধকতা বা প্রথা অনুযায়ী কার্যক্রম সম্পন্ন করা।

ইসলামে সওয়াব বা পূণ্যের জন্য মূলত কাজের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। যদি কোনও কাজ একান্তই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয় এবং তা ইসলামিক শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তবে সেই কাজের জন্য সওয়াব প্রাপ্ত হয়। কিন্তু যদি লৌকিকতা বা সামাজিক সম্মান, লোক দেখানো, অথবা অন্যের প্রশংসা লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করা হয়, তাহলে সেই কাজের জন্য সওয়াব অর্জিত হয় না।

যদি কোনো কাজের মধ্যে লৌকিকতার উপাদান থাকে, কিন্তু সেই কাজটি ধর্মীয়ভাবে সঠিক এবং একজন ব্যক্তি একান্তভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেন, তবে সেই কাজের জন্য সওয়াব পাওয়া সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ:

1. দান করা: যদি কেউ লোক দেখানোর জন্য বা প্রশংসা পাওয়ার জন্য দান করে, তবে সে দানের জন্য সওয়াব হবে না। কিন্তু একই দান যদি একান্তই আল্লাহর জন্য হয় এবং মানুষ তার প্রশংসা করলেও তার উদ্দেশ্য শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়, তাহলে সেই দানের জন্য সওয়াব হবে।

2. নামাজ বা ধর্মীয় কাজ: যদি কেউ শুধুমাত্র সামাজিক মর্যাদা বা লোক দেখানোর জন্য নামাজ পড়ে, তাহলে তা রিয়া হবে এবং এই ধরনের কাজের জন্য সওয়াব পাওয়া যাবে না। কিন্তু আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতা রেখে কাজ করলে সওয়াব পাওয়া যায়।
অর্থাৎ, লৌকিকতা তখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে, যখন তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয়, আর লোকের প্রশংসা তাৎপর্যপূর্ণ নয়।


১) নামাজ শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় জানতে পারলাম মেহমান চলে এসেছে। এজন্য মেহমান ঘরে প্রবেশ করা পর্যন্ত জায়নামাজে বসে থাকলাম। সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত না হলেও অবচেতন মন চাইছে নামায যে পড়তেছি মেহমান দেখুক। এটি রিয়া।

২) কেউ জিজ্ঞেস করলো– আপনি কি করছেন?
উত্তরে বললাম– আমি নামাজ পড়ে উঠে নাস্তা করতেছি বা নামাজ পড়ে উঠে এখন রান্না করতেছি।

এখানে শুধু নাস্তা বা রান্না করার কথা বললেই হতো।
সাথে 'নামাজ পড়ে উঠে' কথাটি জুড়ে দিয়ে অতি সূক্ষ্মভাবে নামাজ কে প্রচারে নিয়ে আসা হলো। এটি রিয়া।

৩) ফজরে যে নামাজ পড়তে উঠলাম কিন্তু কেউ জানলো না। তাই সেটা মানুষকে জানানোর জন্য দিলাম ফেসবুকে একটা পোস্ট। লিখলাম– 'সবাই নামাজ পড়তে উঠুন'।

আমি জানি আমার এই পোস্টে কারোও ঘুম ভাঙবেনা বা কেউ দেখে নামাজে যাবেনা। তাও দিলাম। মোদ্দাকথা নামাজের ব্যাপারটা সবাইকে জানাতেই হবে। এটি রিয়া।

৪) নফল রোজা রেখে দুপুরে বন্ধুর সাথে চ্যাট করছি। হঠাৎ আউট অফ টপিক তাকে জিজ্ঞেস করেছি– 'ভাত খেয়েছিস কিনা?'। অথচ আজীবন তার ভাতের খবর নেয়নি।
সে হ্যাঁ/না উত্তরের সাথে যে 'তুই খেয়েছিস?'এটা জিজ্ঞেস করবে সেটার গ্যারান্টি সূর্য উঠার মতোই।
সে সুযোগে– না দোস্ত রোজা রেখেছি বলে রোজার প্রচার করে দিলাম। এটি রিয়া।

৫) কোরবানির গরু কিনলাম। 
অফলাইনের আশেপাশের সবাই দেখলেও অনলাইন বন্ধুদের সামনে তো আর শো-অফ করা হলো না।

তাই প্রাইভেসি পাবলিক করে দিয়ে দিলাম পোস্ট– আলহামদুলিল্লাহ্‌ 'Done'। এটি রিয়া।

লাইক, লাভের ছড়াছড়িতে বন্যা বয়ে গেছে। অনেকেই দেখি দাম জিজ্ঞেস করলো। সেই সুযোগে জিতা-হারার প্রচারটাও হয়ে গেলো।

৬) বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় মজার ছলেই টেকনিকে বলে দিলাম– তুই বেটা কিপটা। কিছুই দান করিস না। প্রত্যুত্তরে– তুই কি দান করে উল্টিয়ে ফেলছিস? এই প্রশ্নটা যে করবে, তা জানুয়ারির পর ফেব্রুয়ারি আসার মতোই নিশ্চিত আমি। সাথে সাথেই দিয়ে দিলাম আমার দানের লিস্ট সম্পূর্ণ ডিটেইলস সহকারে। এটি রিয়া

আমার এই দান পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে প্রচারের জন্য আমার স্ত্রী তো আছেনই।

উপরের প্রত্যেক উদ্দীপক পড়ে কিছু আয়ত্ত করতে পারলেন কি? একেই বলে রিয়া।

এতোক্ষণ যে ইবাদত গুলো করলাম সেগুলা কি আল্লাহর জন্য? নাকি লোক দেখানো? লোক দেখানো মানেই রিয়া।
কখনো ভেবেছেন এসব ইবাদত আদৌও কবুল হবে কি? উপরোক্ত প্রত্যেকটি ইবাদতই হলো রিয়া।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রিয়াকে ছোট শিরক বলেছেন। 
তিনি বলেন– 'আমি তোমাদের ব্যাপারে ছোট শিরক নিয়ে যতোটা ভয় পাচ্ছি, অন্য কোনো ব্যাপারে এতোটা ভীত নই'। তারা (সাহাবি) বললেন– হে আল্লাহর রাসূল। ছোট শিরক কী?  তিনি বলেন– রিয়া বা প্রদর্শনপ্রিয়তা। আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের প্রতিদান প্রদানের সময় বলবেন– 'তোমরা পৃথিবীতে যাদের দেখাতে, তাদের কাছে যাও। দেখো তাদের কাছে তোমাদের কোনো প্রতিদান আছে কি না? [১]

আল-কোরআনেও আল্লাহ্ লোকদেখানো ইবাদত থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। 
ইরশাদ হয়েছে– 'যে ব্যক্তি তার প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেনো সৎ কাজ করে এবং তার প্রভুর ইবাদতে কাউকে অংশীদার না করে'। [২]

অন্য আয়াতে যারা লোকদেখানো ইবাদত করে তাদের নিন্দা করে বলা হয়েছে– 'ধ্বংস সেসব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন, যারা প্রদর্শন করে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস দেয়া থেকে বিরত থাকে'। [৩]

উল্লেখিত আয়াত ও হাদিসের আলোকে ইসলামী জ্ঞানতাপসরা রিয়াকে কবিরা গুনাহ (বড় পাপ) ও হারাম বলেছেন। 
আল্লামা ইবনে কায়্যিম (রাহি.) কবিরা গুনাহের তালিকার প্রথমে রিয়ার আলোচনা করেছেন। ইমাম গাজ্জালি (রাহি.) বলেছেন– 'জেনে রাখো। নিশ্চয়ই প্রদর্শনপ্রিয়তা হারাম। প্রদর্শনকারী আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয়। আয়াত, হাদিস ও পূর্ববর্তী আলেমদের বক্তব্য দ্বারা তা প্রমাণিত'। [৪]

বান্দার আমলে রিয়া যদি ইচ্ছাকৃত হয়; তবে তা যতো গৌণই হোক, সে আমল আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে– আল্লাহ্ তায়ালা বলেন 'আমি শরিককারীদের শরিক থেকে অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোনো আমল করলো এবং তাতে আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করলো, আমি তাকে ও যাকে সে শরিক করল তাকে প্রত্যাখ্যান করি'। [৫]

তবে রিয়া যদি অনিচ্ছায় হয়, বান্দা তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে এবং এ জন্য অনুতপ্ত হয়, তবে গ্রহণযোগ্য মতো হলো, এমন ইবাদত আল্লাহর দরবারে প্রত্যাখ্যাত হবে না। ব্যক্তি রিয়া নামক ছোট শিরক থেকে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আশা করা যায় ব্যক্তি ইবাদতের দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তবে তার প্রতিদান কী হবে, তা আল্লাহই ভালো জানেন।
আল্লাহ আমাদের রিয়ামুক্ত ইবাদতের তৌফিক দান করুক। আমিন।

ফুটনোট—
[১] (মুসনাদে আহমদ, হাদিসঃ ২২৫২৮)
[২] (সূরা কাহাফ, আয়াতঃ ১১০)
[৩] (সূরা মাউন, আয়াতঃ ৪-৭)
[৪] (ইহয়াউ উলুমিদ্দিনঃ ২/৪৮০)
[৫] (সহীহ্ মুসলিম, হাদিসঃ ৩৫২৮)

আলোচিত আর্টিকেলের বিষয়বস্তু আপনাকে যদি স্পর্শ করে থাকে এবং আপনি রিয়া সম্পর্কে আরও জানতে চান, তাহলে ইমাম গাজ্জালীর এই অমূল্য গ্রন্থটি ডাউনলোড করে পড়ার মাধ্যমে আপনি নিজের আত্মিক উন্নতি সাধন করতে পারেন।

এ বিষয়ে ইমাম গাজ্জালী রহঃ এর লিখিত "রিয়া লোক দেখানো ইবাদত" বইটি ডাউনলোড করতে পারেন। 


ইমাম গাজ্জালী (রহ.) একজন বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত, যার লেখনীতে মানব আত্মা ও ইবাদতের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের উপর গভীর আলোচনা রয়েছে। তাঁর বই "রিয়া: লোক দেখানো ইবাদত" এই বিষয়ের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যেখানে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কিভাবে রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত একজন ব্যক্তিকে সওয়াব থেকে বঞ্চিত করতে পারে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। 


এই বইটি শুধু রিয়ার পরিচয় নয়, বরং এর ক্ষতিকর প্রভাব, তা থেকে বাঁচার উপায়, এবং ইসলামে খাঁটি ইবাদতের গুরুত্ব নিয়ে গভীর আলোকপাত করে। যারা নিজেদের ইবাদত ও কর্মে আন্তরিকতা বজায় রাখতে চান এবং আল্লাহর নৈকট্য পেতে আগ্রহী, তাদের জন্য এই বইটি অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post
icon যে কোন প্রয়োজনে টেলিগ্রাম চ্যানেলে মেসেজ দিন