সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের এক প্রভাবশালী ও বিতর্কিত শাসক। তার জীবন, ব্যক্তিত্ব এবং শাসন উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনপূর্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে চিহ্নিত করে। তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের ৩৪তম সুলতান ছিলেন এবং প্রায় ৩৩ বছর (১৮৭৬-১৯০৯) শাসন করেছিলেন।
প্রাথমিক জীবন:
সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়ের জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৪২ সালে ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদে। তিনি সুলতান আব্দুল মজিদ প্রথম এবং তার স্ত্রী তিরমুজগান কাজের (এক আর্মেনীয় কন্যা) সন্তান ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি একটি আধুনিক শিক্ষা লাভ করেন, যা তাকে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেয়। তার শৈশব থেকেই তিনি শিল্পকলার প্রতি আকর্ষণী ছিলেন এবং তিনি বিশেষ করে কবিতা, বাদ্যযন্ত্র, এবং স্থাপত্যে আগ্রহী ছিলেন।
সিংহাসনে আরোহণ:
৩১ আগস্ট ১৮৭৬ সালে তার ভাই মুরাদ পঞ্চম মানসিকভাবে অস্থিতিশীলতার কারণে ক্ষমতাচ্যুত হলে আব্দুল হামিদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। সেই সময়ে উসমানীয় সাম্রাজ্য ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈদেশিক চাপের মধ্যে ছিল। তার শাসনের প্রথম দিকে তিনি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ১৮৭৬ সালে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ছিল তার আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টার একটি অংশ। এই সংবিধানের ফলে উসমানীয় সাম্রাজ্যে প্রথম সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়।
শাসনকাল ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ:
শাসনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি একটি সাংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও ১৮৭৮ সালে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধের পর তিনি সংসদকে স্থগিত করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা করার জন্য শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রয়োজন। তার শাসনকালে সাম্রাজ্যটির ভৌগোলিক বিস্তৃতি কমতে থাকে এবং বলকান অঞ্চলের অনেক দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
১. **তানজিমাত সংস্কার:** আব্দুল হামিদ তার পূর্বসূরিদের সময় শুরু হওয়া তানজিমাত সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন, যা উসমানীয় সাম্রাজ্যের আধুনিকীকরণের চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল। তবে তার শাসনের দ্বিতীয়ার্ধে তিনি অধিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য এই সংস্কার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন।
২. আর্মেনীয় গণহত্যা: ১৮৯৪-১৮৯৬ সালের মধ্যে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ঘটে, যা ইতিহাসে "হামিদিয়ান গণহত্যা" নামে পরিচিত। এর ফলে আব্দুল হামিদকে "রক্তাক্ত সুলতান" (The Red Sultan) বলা হয়।
৩. তরুণ তুর্কি আন্দোলন: ১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কিরা এক বিপ্লব ঘটায়, যা আব্দুল হামিদের শাসনের পতনের সূচনা করে। তরুণ তুর্কিরা সাংবিধানিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং ১৯০৯ সালে আব্দুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠায়।
৪. হেজাজ রেলপথ: মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি হেজাজ রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করেন, যা মক্কা ও মদিনার সাথে সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ বৃদ্ধি করে।
ক্ষমতাচ্যুতি ও পরবর্তী জীবন:
১৯০৯ সালে সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় তরুণ তুর্কি বিপ্লবের ফলে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং তাকে থেসালোনিকিতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরে তাকে ইস্তাম্বুলে নিয়ে আসা হয় এবং সেখানে তিনি বাকী জীবন কাটান। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯১৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহাসিক মূল্যায়ন:
সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় ছিলেন একজন জটিল ও বিচিত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার শাসনকাল উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষের দিকে একটি সংকটময় সময় হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। তিনি ছিলেন রক্ষণশীল এবং ইসলামের প্রতি গভীর আনুগত্যশীল, তবে তিনি পশ্চিমা শক্তির আধিপত্য প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। তার শাসন আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়কে নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিস্তৃত আলোচনা এবং সমালোচনা রয়েছে। তার শাসনামল ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের সংকটপূর্ণ একটি সময়, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ শাসক, তবে তার কিছু কঠোর নীতি ও সিদ্ধান্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। নিচে তার শাসনামল নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও সমালোচনার দিকগুলো তুলে ধরা হলো:
আলোচনা (পজিটিভ দিক):
1. আধুনিকীকরণের প্রচেষ্টা:
আব্দুল হামিদ সাম্রাজ্যকে পশ্চিমা সামরিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি রেলপথ, টেলিগ্রাফ এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন আধুনিকীকরণমূলক প্রকল্প হাতে নেন। তার শাসনামলে হেজাজ রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়, যা হজযাত্রীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
2. ইসলামের প্রতি আনুগত্য:
সুলতান ইসলামের প্রতি গভীর আনুগত্যশীল ছিলেন এবং নিজেকে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তার শাসনামলে ইসলামিক ঐক্যের ধারণা জোরদার হয়েছিল। তিনি মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ধর্মীয় সংহতি স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেন।
3. উসমানীয় সাম্রাজ্য সংরক্ষণ:
আব্দুল হামিদের শাসনকাল ছিল একটি সংকটপূর্ণ সময়, যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলো উসমানীয় সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল করার চেষ্টা করছিল। তিনি সাম্রাজ্যের পতন ঠেকানোর জন্য কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রচেষ্টা চালান এবং একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
4. সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা:
তিনি সংস্কৃতি, শিক্ষা, এবং সাহিত্যকে উৎসাহিত করতেন। তার আমলে অনেক নতুন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং পশ্চিমা শৈলী শিক্ষাকে উসমানীয় সাম্রাজ্যে প্রবর্তনের চেষ্টা করেন।
সমালোচনা (নেগেটিভ দিক):
1. একনায়কতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদ:
আব্দুল হামিদ ১৮৭৮ সালে সংসদ স্থগিত করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন। তিনি নিজের শাসনকে শক্তিশালী করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন-পীড়ন চালান। তাকে একনায়কতান্ত্রিক শাসক হিসেবে দেখা হয়, যা সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
2. আর্মেনীয় গণহত্যা:
তার শাসনামলে ১৮৯৪-১৮৯৬ সালে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়, যা ইতিহাসে "হামিদিয়ান গণহত্যা" নামে পরিচিত। এই ঘটনা তার শাসনের উপর একটি কালো দাগ হিসেবে দেখা হয় এবং তাকে "রক্তাক্ত সুলতান" (The Red Sultan) নামে অভিহিত করা হয়।
3. স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের প্রতি দমননীতি:
আব্দুল হামিদ বলকান অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করেন। তার কঠোর নীতির কারণে এই আন্দোলনগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
4. তরুণ তুর্কি আন্দোলনের দমন:
তার শাসনামলে তরুণ তুর্কি (Young Turks) নামে পরিচিত একটি প্রগতিশীল গোষ্ঠী গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক সংস্কারের দাবি তুলেছিল। আব্দুল হামিদ তাদের আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেন। তবে শেষ পর্যন্ত ১৯০৮ সালে তরুণ তুর্কিদের বিপ্লবের ফলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
5. কূটনৈতিক ব্যর্থতা:
ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে আব্দুল হামিদ কূটনৈতিকভাবে অসফল হন। বিশেষ করে রাশিয়া, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাথে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, যা সাম্রাজ্যের পতনের দিকে আরও ত্বরান্বিত করে।
সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়ের শাসনকাল ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষের দিকে একটি চ্যালেঞ্জপূর্ণ সময়। তার আধুনিকীকরণ প্রচেষ্টা এবং ইসলামের প্রতি আনুগত্য সত্ত্বেও, তার কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং বিভিন্ন বিদ্রোহ ও আন্দোলন দমনের জন্য তাকে সমালোচিত করা হয়। তার শাসনামল একটি মিশ্র প্রভাব ফেলে—একদিকে তিনি সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হলেও, অন্যদিকে তার কঠোর নীতি ও একনায়কতন্ত্র উসমানীয় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও পতনের পথে সহায়ক হয়।
Post a Comment