আজ ৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাবলীগ, মাদ্রাসা, এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার্থে মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাবলীগ জামাতের ঐক্য, ধর্মীয় শিক্ষা প্রচার, এবং আলেমদের অধিকার রক্ষার দাবিগুলোকে সামনে আনা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এবং এতে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এসব দাবির মধ্যে তাবলীগ জামাতের ঐক্য রক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, এবং কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়।
আলেমরা দাবি করেন যে, ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি এবং ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তার বাধাগ্রস্ত হলে তা ধর্মীয় ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান যে এসব দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে দেশের শান্তি ও ইসলামী মূল্যবোধ বজায় রাখতে পদক্ষেপ নেয়া হোক।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এই মহা সম্মেলনে মাওলানা সা'দের বাংলাদেশে আসার বিরোধিতা এবং তাবলীগ জামাতের নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে কিছু বিশেষ দাবি এবং বক্তব্য উঠে এসেছে। এখানে মূলত দেশের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে তাদের উদ্বেগ এবং চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। চলুন প্রতিটি দফার মূল বিষয়টি একটু বিশদভাবে দেখি:
১. তাবলীগ নিয়ে ষড়যন্ত্র বন্ধ: তাবলীগ জামাতের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অভ্যন্তরীণ বিভেদ দেখা দিয়েছে, যা এই সংগঠনটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সম্মেলন থেকে এই ষড়যন্ত্র বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
২. শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক: শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সাধারণ শিক্ষার সিলেবাসে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানানো হয়েছে।
৩. আলেমদের মামলা প্রত্যাহার: আগে বিভিন্ন সরকারের সময়ে আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সম্মেলন থেকে এইসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি করা হয়েছে।
৪. শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার: ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে সারাদেশ থেকে আগত নবীপ্রেমিক নিরীহ ছাত্র-জনতা ও মুসল্লীদের উপর বর্বরোচিত ও নৃশংস গণহত্যার দোষীদেরকে অবিলম্বে শাস্তির আওতায় এনে বিচার কার্যকর করতে হবে এরং সারাদেশের আলেম, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার উপর দায়েরকৃত মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. টঙ্গীতে সাদপন্থীদের আক্রমণের বিচার:
২০১৮ সালের পহেলা ডিসেম্বর টঙ্গী ময়দানের জোড়ের প্রস্তুতিমূলক কাজে অংশগ্রহণকারী মাদরাসার নিরীহ ছাত্র- শিক্ষক এবং সাধারণ তাবলীগী সাথী ভাইদের উপর সাদপন্থিরা পুলিশ প্রশাসনের গুটিকয়েক অফিসারের সহযোগিতায় নৃশংস হামলা চালায়। আজকের এ মহাসম্মেলন থেকে উক্ত হামলাকারী ও তাদের সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানানো হচ্ছে।
৬. মাওলানা সা'দের প্রবেশ নিষিদ্ধ: স্বঘোষিত আমির মাওলানা সাদ সাহেব কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা, নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদা-বিশ্বাস বিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। আরও উল্লেখ্য যে, দাওয়াত ও তাবলীগের এই মকবুল মেহনত যুগ যুগ ধরে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. হযরত মাওলানা ইউসুফ রহ, ও হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রহ. এর উসুলের উপর পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু মাওলানা সাদ সাহেব তাবলীগ জামাতের স্বীকৃত উসূল তথা নীতিমালা উপেক্ষা করে নিজস্ব মতের ভিত্তিতে পরিচালনা করার অপপ্রয়াস চালায়।
এ কারণে দারুল উলুম দেওবন্দসহ উপমহাদেশের প্রখ্যাত উলামায়ে কেরাম তার গুমরাহিপূর্ণ বক্তব্য ও অবস্থানের ব্যাপারে উম্মাহকে সতর্ক করেছেন। তাই ইতিপূর্বে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান সাদ সাহেবকে বাংলাদেশে আসতে বাধা প্রদান করেছে। বিধায় বর্তমান সরকারের নিকট অদ্যকার মহাসম্মেলন থেকে জোর দাবি জানানো হচ্ছে যে, কোনো অবস্থাতেই মাওলানা সাদ সাহেবকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না।
৭. দুই পর্বের বিশ্ব ইজতেমা: উলামায়ে করামের তত্ত্বাবধানে শুরায়ী নেযামে পরিচালিত বিশ্ব ইজতেমা এক পর্বে আয়োজন করা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তাই আগামী বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বেই অর্থাৎ ৩১ জানুয়ারি ও ১, ২ ফেব্রুয়ারি ২৫ শুক্রবার, শনিবার ও রোববার এবং দ্বিতীয় পর্ব ৭, ৮, ৯ ফেব্রুয়ারি ২৫ শুক্রবার, শনিবার ও রোববার করার তারিখ আজকের এ মহাসম্মেলন থেকে ঘোষণা করা হলো।
৮. কাকরাইল পরিচালনায় শুরায়ি নেজাম: কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার ময়দানের যাবতীয় কার্যক্রম উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে শুরায়ী নেযামে পরিচালিত হবে। উক্ত স্থানন্বয়ে সাদপন্থীদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না।
৯. কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা: বর্তমান সরকারকে ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন অভিশপ্ত কাদিয়ানীদের অবিলম্বে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং সেই সঙ্গে কাদিয়ানীদের ইসলামী পরিভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ করারও জোর দাবি জানাচ্ছে আজকের এ মহাসম্মেলন।
এইসব দাবিগুলো মূলত তাবলীগ জামাতের মধ্যে বিভাজন, ধর্মীয় আদর্শ এবং আলেম সমাজের সমস্যাগুলোর প্রতিফলন। এর মাধ্যমে ধর্মীয় সম্প্রদায় তাদের অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণের দাবিগুলি সামনে এনেছে।
সম্মেলনের এসব দফা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভাবনা, উদ্বেগ ও চাহিদাগুলোকে স্পষ্ট করে তোলে। ধর্মীয় শিক্ষার মূল্যবোধ, আলেমদের অধিকার, এবং জাতীয় ও ধর্মীয় ঐক্য রক্ষায় সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে এই দাবিগুলো গুরুত্বপূর্ণ।
মাওলানা সা'দের বাংলাদেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার মতো কঠোর অবস্থান এবং তাবলীগের মধ্যে বিভক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা, সামগ্রিকভাবে একটি সুসংহত এবং শক্তিশালী ধর্মীয় আন্দোলনের ইঙ্গিত বহন করে। এটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা, সুষ্ঠু বিচার এবং ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেও কাজ করবে।
এই সম্মেলন থেকে উচ্চারিত দাবিগুলো রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব, আলেমদের ভূমিকা, এবং সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় ঘটনাবলীর দিকে লক্ষ্য করে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ফলে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, নৈতিক শিক্ষার সংস্থান এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রভাব সম্পর্কে নতুন ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে।
অবশেষে, এই মহাসম্মেলন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আওতাভুক্ত বিভিন্ন মহলের মধ্যে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রেরণ করেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় আন্দোলন ও আলেম সমাজের গঠনমূলক ভূমিকার প্রতি গুরুত্বারোপ করে।
Post a Comment