১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস: গৌরবময় এক অধ্যায়।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১—বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। এই দিনটি আমাদের বিজয়, স্বাধীনতা, ও আত্মমর্যাদার প্রতীক। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত, ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিজয় দিবস শুধু একটি তারিখ নয়; এটি বাঙালির আত্মত্যাগ, ঐক্য, এবং আত্মমর্যাদার অবিস্মরণীয় স্মারক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদী ও সংগ্রামী পথচলা। বাঙালি জাতির উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বঞ্চনা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। ভাষার জন্য আন্দোলন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, এবং রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে বঞ্চনার বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে বাঙালির গণআন্দোলন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়। তিনি বলেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।"
২৫শে মার্চ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় "অপারেশন সার্চলাইট" নামের নির্মম গণহত্যা চালিয়ে বাঙালির প্রতি তাদের নিষ্ঠুরতার চরম প্রমাণ দেয়। এর পরেই শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল রক্ত, অশ্রু এবং ত্যাগের ইতিহাস। পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার, গণহত্যা, এবং অমানবিক আচরণ সত্ত্বেও বাঙালি জাতি লড়াই চালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা এবং দেশের সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এটি ছিল বাঙালির জন্য একটি স্বর্ণালী মুহূর্ত, যখন লাল-সবুজের পতাকা স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে আকাশে উড়েছিল।
বিজয় দিবস আমাদের জন্য শুধু আনন্দের দিন নয়, এটি আমাদের আত্মমর্যাদা এবং স্বপ্নেরও দিন। এই দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু একটি ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য ছিল না; এটি ছিল একটি স্বপ্নের জন্য—একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক, ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য।
আজকের বিজয় দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদের কথা, যাঁরা নিজের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনেছেন। তাঁদের আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অমূল্য সম্পদ। তাঁদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
আমাদের দায়িত্ব হলো, এই স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা। দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে হলে আমাদের সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং শিল্পে উন্নতি সাধন করতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে, যেন তারা আমাদের অর্জিত স্বাধীনতার মূল্য বুঝতে পারে।
বিজয় দিবসের গুরুত্ব আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এটি আমাদের শিক্ষা দেয়, জাতি হিসেবে আমরা একত্রিত হলে যেকোনো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে পারি। বিজয়ের পতাকা আমাদের গর্বের প্রতীক। আসুন, এই মহান দিনে আমরা শপথ নেই, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, এবং শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলবো।
Post a Comment