হাশরের ময়দানে মানুষ যে সাতটি আফসোস করবে। কিয়ামতের ভয়াবহতা ও শিক্ষা

কিয়ামত এমন এক দিন, যেদিন দুনিয়ার সমস্ত কাজের হিসাব নেওয়া হবে। পাপীরা ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে, আর মুমিনরা মহান প্রভুর নিকট পুরস্কৃত হবে। কুরআন মাজিদে কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ চিত্র ও পাপীদের আফসোসের কথাগুলো বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এসব আয়াতের উদ্দেশ্য আমাদের সতর্ক করা এবং নেক আমলের প্রতি উৎসাহিত করা। এখানে সেই আয়াতগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।

কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা

কিয়ামত কেমন হবে? কিয়ামতের দিন আকাশ ফেটে যাবে, পাহাড়গুলো উড়ে যাবে, এবং সাগরের পানি উথাল-পাথাল হয়ে যাবে। দুনিয়ার সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। কুরআনে এই ভয়াবহ দৃশ্য বর্ণিত হয়েছে:
"إِذَا السَّمَاءُ انشَقَّتْ"
(যখন আকাশ ফেটে যাবে।) সূরা ইনশিকাক-১
"وَإِذَا الْجِبَالُ سُيِّرَتْ"
(যখন পাহাড়গুলোকে চালিয়ে দেওয়া হবে।) সূরা তাকভির-৩
এই দৃশ্য এতই ভীতিকর হবে যে, মায়েরা নিজেদের সন্তানকে ভুলে যাবে এবং গর্ভবতী নারীর গর্ভপাত হবে। মানুষ দিশাহারা হয়ে ছুটবে, কিন্তু কোথাও আশ্রয় খুঁজে পাবে না।
"يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ، وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ"
(সেদিন মানুষ পালাবে তার ভাই থেকে, তার মা ও তার বাবা থেকে।) সূরা আবাসা, আয়াত ৩৪-৩৫

কিয়ামত এমন এক ভয়াবহ দিন, যেদিন সমস্ত মানবজাতি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। প্রত্যেককে তার আমল অনুযায়ী হিসাব দিতে হবে। সেদিন দুনিয়ার সমস্ত ভোগবিলাস, মান-মর্যাদা এবং সম্পদ মূল্যহীন হয়ে যাবে। পাপীদের জন্য এটি হবে আফসোসের দিন, যখন তারা দুনিয়ার জীবনে ভুল সিদ্ধান্ত ও পাপের জন্য অনুতপ্ত হবে। কুরআন ও হাদিসে বারবার কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং পাপীদের আক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। এখানে সেই আয়াতগুলোর বিশ্লেষণ এবং এর শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হলো।

১. হায়! যদি আমি মাটি হয়ে যেতাম

"يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا"
(হায়! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম।) সূরা আন-নাবা, আয়াত ৪০

এই আয়াতে কাফিরদের এক গভীর আফসোসের কথা বলা হয়েছে। কিয়ামতের দিনে তারা দেখতে পাবে তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে। তারা এমন এক যন্ত্রণার সম্মুখীন হবে যা থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। তখন তারা বলবে, "হায়! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম!" অর্থাৎ, যদি তারা সৃষ্টি না হতো বা সৃষ্টি হওয়ার পর জীবহীন মাটির মতো পরিণতি হতো।

হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:  যে ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করবে না এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেবে না, সে কিয়ামতের দিনে চরম অনুতপ্ত হবে।" (সহিহ মুসলিম)

দুনিয়ার শিক্ষা: আমরা যদি এই আয়াতের গুরুত্ব বুঝি, তবে আমাদের দুনিয়ার জীবনকে পরকালের জন্য প্রস্তুতির একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আমল ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা ছাড়া কিয়ামতের দিন মুক্তি অসম্ভব।

২. হায়! যদি আমি পরকালের জন্য কিছু করতাম

"يَا لَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَاتِي"
(হায়! যদি আমি আমার জীবনের জন্য কিছু করতাম।) সূরা আল-ফজর, আয়াত ২৪

এ আয়াতে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন এবং পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের মধ্যে পার্থক্য বোঝানো হয়েছে। দুনিয়ার জীবন একদিন শেষ হবে, কিন্তু পরকালের জীবন চিরস্থায়ী। দুনিয়ার লোভে যারা পরকালকে অবহেলা করবে, তারা কিয়ামতের দিন আক্ষেপ করে বলবে, "হায়! যদি আমি দুনিয়ায় কিছু আমল করতাম!"

হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: "স্মারক দুটি জিনিসকে সর্বদা মনে রাখ: মৃত্যু ও কিয়ামত।" (তিরমিজি)

দুনিয়ার শিক্ষা: আমাদের উচিত প্রতিদিনের কাজ ও সিদ্ধান্ত পরকালের কথা মাথায় রেখে গ্রহণ করা। নামাজ, রোজা, যাকাত এবং অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করা।

৩. হায়! যদি আমার আমলনামা না দেওয়া হতো

"يَا لَيْتَنِي لَمْ أُوتَ كِتَابِيَهْ"
(হায়! আমাকে যদি আমার আমলনামা না দেওয়া হতো।)
সূরা আল-হাক্কা, আয়াত ২৫

এই আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, যাদের আমলনামা বাম হাতে দেওয়া হবে, তারা তাদের কৃতকর্ম দেখে আতঙ্কিত হবে। তারা এমন ভয় পাবে যে, আমলনামা হাতে নেওয়ার পরিবর্তে তা গোপন রাখতে চাইবে। তাদের সমস্ত গোপন পাপ প্রকাশ হয়ে যাবে।

কুরআনের ব্যাখ্যা: "এবং যাকে তার আমলনামা বাম হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে: হায়! যদি আমি আমার আমলনামা না পেতাম এবং যদি জানতে না পেতাম আমার হিসাব।" (সূরা আল-হাক্কা, আয়াত ২৫-২৬)

দুনিয়ার শিক্ষা: আমলনামা এমন একটি দলিল যা দুনিয়ার জীবনে আমাদের প্রতিটি কাজের সাক্ষ্য বহন করে। এই আয়াত আমাদের সতর্ক করে যে, আমরা যেন প্রতিটি কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করি।

৪. হায়! যদি আমি রাসূলের পথ অনুসরণ করতাম

"يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا"
(হায়! আমি যদি রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম।) সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ২৭

এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দেখানো পথ ত্যাগ করেছে, তারা কিয়ামতের দিন অনুতপ্ত হবে। তারা উপলব্ধি করবে, দুনিয়ার জীবনে রাসূলের অনুসরণই ছিল মুক্তির একমাত্র পথ।

হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: "তোমরা আমার সুন্নাহকে আঁকড়ে ধর এবং তা ছেড়ে দিও না।" (তিরমিজি)

দুনিয়ার শিক্ষা: আমাদের উচিত রাসূলের সুন্নাহকে মেনে চলা এবং তার দেখানো পথ অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবন আমাদের জন্য পরিপূর্ণ আদর্শ।

. হায়! যদি ওকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম

"يَا وَيْلَتَىٰ لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا"
(হায়! আমি যদি ওকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।) সূরা আল-ফুরকান, আয়াত ২৮

এই আয়াতে বলা হয়েছে, দুনিয়ার জীবনে খারাপ সঙ্গীদের কারণে যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে, তারা কিয়ামতের দিন আক্ষেপ করবে। খারাপ বন্ধুর প্ররোচনায় তারা নেক আমল করতে পারেনি।

হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: "ভালো বন্ধু সেই ব্যক্তি, যার সঙ্গ তোমাকে নেকির পথে নিয়ে যায়। আর খারাপ বন্ধু সে, যে তোমাকে পাপের দিকে টেনে নেয়।" (সহিহ বুখারি)

দুনিয়ার শিক্ষা: আমাদের উচিত বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক থাকা। এমন বন্ধু নির্বাচন করতে হবে যারা আমাদের নেক কাজের প্রতি উৎসাহিত করবে।

৬. হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করতাম

"يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا"
(হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করতাম।) সূরা আল-আহযাব, আয়াত ৬৬

এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, যারা আল্লাহর বিধান এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ অমান্য করেছে, তারা কিয়ামতের দিন এই কথা বলবে। তারা বুঝবে যে, তাদের সমস্ত কষ্টের মূল কারণ ছিল আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ অমান্য করা।

দুনিয়ার শিক্ষা: আমাদের উচিত সর্বদা আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ মেনে চলা। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী মুনাফার জন্য কখনোই পরকালের সফলতা ত্যাগ করা উচিত নয়।

. হায়! যদি আমি আমার রবের সঙ্গে কাউকে শরীক না করতাম

"يَا لَيْتَنِي لَمْ أُشْرِكْ بِرَبِّي أَحَدًا"
(হায়! আমি যদি আমার রবের সঙ্গে কাউকে শরীক না করতাম।) সূরা আল-কাহফ, আয়াত ৪২

শিরক এমন একটি পাপ যা আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। যারা দুনিয়ার জীবনে শিরক করেছে, তারা কিয়ামতের দিন চিরস্থায়ী শাস্তি ভোগ করবে।

হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: "শিরক থেকে দূরে থাকো। এটি এমন একটি গুনাহ, যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না।" (সহিহ মুসলিম)

দুনিয়ার শিক্ষা: আমাদের উচিত আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করা এবং তাওহিদের পথে অটল থাকা।

কিয়ামতের দিন এমন এক ভয়াবহ দিন হবে, যেদিন সূর্য মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসা হবে, আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, আর মানুষ তার দুনিয়ার কাজের জন্য চরমভাবে আফসোস করবে। কিয়ামতের দিন সকালের সূচনা হবে এমন ভয়াবহতায়, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করেনি, তারা বলবে, "হায় আফসোস! এ কেমন আমলনামা, যেখানে প্রতিটি কাজ লেখা রয়েছে!" পাপীরা তাদের বাম হাতে আমলনামা পাবে, আর মুমিনরা ডান হাতে। 

পরকালে আমলনামা হাতে পাওয়ার পর জাহান্নামিরা ভয়ংকর শাস্তির মুখোমুখি হবে এবং বলবে, "হায়! যদি আমরা দুনিয়ায় সৎকর্ম করতাম।" রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাদিসে বলেছেন, "কিয়ামতের দিন পাপীরা নিজেদের দুনিয়ার জীবন নিয়ে অনুতপ্ত হবে।" দুনিয়ার ফাঁদে পড়ে যারা আল্লাহর পথ ত্যাগ করেছে, তাদের জন্য কিয়ামতের দিন হবে আফসোসের দিন। 

তাই আজই আমাদের উচিত আল্লাহর পথে ফিরে আসা, যেন সেই দিন আমাদের জন্য আফসোসের কারণ না হয়। কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং পাপীদের আফসোস আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের জন্য এই আয়াতগুলো নাযিল করেছেন, যেন আমরা সময় থাকতে সতর্ক হই। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, আর পরকাল চিরস্থায়ী। আমাদের উচিত প্রতিটি কাজ পরকালের কথা ভেবে করা।

আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন এবং কিয়ামতের ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন