Three punishments for three crimes
ইসলামী জীবনব্যবস্থায় কাজের ভালো বা মন্দ ফলাফল স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। কুরআন ও হাদিসের শিক্ষায় সততা, নিষ্ঠা ও আল্লাহর আদেশের প্রতি আনুগত্য অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। এমনকি সমাজে সাধারণ কিছু অপরাধেরও ফল হতে পারে বড় ধরনের দুর্যোগ বা বিপর্যয়। ইসলামী শরীয়তের আলোকে, মানুষ যখন নৈতিকতা ও ন্যায়নীতি থেকে বিচ্যুত হয়, তখন সমাজে বিভিন্ন প্রকারের বিপদ নেমে আসে। ইবনে মাজাহ’র হাদীস (৪০১৯) অনুযায়ী, তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে, যা সামাজিক দুর্যোগ সৃষ্টি করে। সেগুলো হলো:
1. অশ্লীলতার জন্য মহামারী
2. ওজনে কারচুপির জন্য দুর্ভিক্ষ
3. যাকাত না দেয়ার জন্য অনাবৃষ্টি
এই প্রবন্ধে আমরা কুরআন ও হাদিসের আলোকে এই তিনটি বিষয়ে আলোচনা করব।
১. অশ্লীলতার জন্য মহামারী:
ইসলামে অশ্লীলতা ও অসামাজিক কার্যকলাপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কুরআন এবং হাদিসে বারবার বলা হয়েছে যে, সমাজে অশ্লীলতার বিস্তার আল্লাহর ক্রোধের কারণ হতে পারে, যা মহামারী আকারে সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
কুরআনে কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَىٰ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
"আর ব্যভিচারের নিকটেও যেয়ো না, নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ এবং অত্যন্ত মন্দ পথ।" (সূরা আল-ইসরা: ১৭:৩২):
এই আয়াতে ব্যভিচারকে অশ্লীল কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা সামাজিক অশান্তি ও দুর্যোগ সৃষ্টি করতে পারে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস:
عن عبد الله بن عمر قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "لم تظهر الفاحشة في قوم حتى يعلنوا بها، إلا فشا فيهم الطاعون والأوجاع التي لم تكن مضت في أسلافهم الذين مضوا."— (ابن ماجه: ٤٠١٩)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন: "যখন কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা প্রকাশ্যে চলে আসে, তখন তাদের মধ্যে মহামারী ও এমন রোগ ছড়িয়ে পড়ে যা পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে কখনো ছিল না।" (ইবনে মাজাহ: ৪০১৯)
এই হাদিসে অশ্লীলতা ও মহামারীর মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট করা হয়েছে। সমাজে যখন নৈতিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পায়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে মহামারী বা রোগব্যাধি নেমে আসে।
২. ওজনে কারচুপির জন্য দুর্ভিক্ষ।
ওজনে কারচুপি করা অর্থাৎ মাপে কম দেয়া বা প্রতারণা করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এটি শুধু ব্যক্তিগত পাপ নয় বরং পুরো সমাজের জন্য ক্ষতিকর একটি কাজ। সমাজে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি ছড়িয়ে পড়লে তার প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, বরং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষের কারণ হতে পারে।
কুরআনে কারিমের সূরা আল-মুতাফফিফিনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ * الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ * وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ
"ধ্বংস তাদের জন্য, যারা ওজনে কম দেয়। যারা যখন অন্যদের থেকে মাপ নেয় তখন পূর্ণ নেয়, আর যখন অন্যদের মাপে বা ওজনে দেয়, তখন কম দেয়।" (সূরা আল-মুতাফফিফিন: ৮৩:১-৩):
এই আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে মাপে কম দেয়াকে ধ্বংসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যখন সমাজে ওজনে কারচুপির প্রবণতা বাড়ে, তখন আল্লাহর রহমত উঠিয়ে নেয়া হয়, ফলে দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখা দেয়।
এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "وما نقص قوم المكيال والميزان إلا أخذوا بالسِّنين وشدة المؤنة وجور السلطان عليهم." — (ابن ماجه: ٤٠١٩)
নবী করীম (সা.) বলেছেন: "যে জাতি ওজনে কারচুপি করে, তাদের উপর দুর্ভিক্ষ, কঠিন জীবনযাপন এবং শাসকদের অবিচার চাপিয়ে দেওয়া হয়।"
এই হাদিসে ওজনে কারচুপির কারণে দুর্ভিক্ষের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। এটি সমাজে ন্যায় ও সততার অভাবের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে আসে।
৩. যাকাত না দেয়ার জন্য অনাবৃষ্টি:
যাকাত ইসলামের অন্যতম মূল স্তম্ভ এবং এটি ধনী ও গরীবের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। যখন সমাজের ধনী ব্যক্তিরা যাকাত না দেয়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে অনাবৃষ্টি নেমে আসে, যা কৃষি ও অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
কুরআনে ইরশাদ হয়েছে
وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ
"আর তাদের সম্পদে ছিল প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার।" (সূরা আয-যারিয়াত: ৫১:১৯):
এই আয়াতে যাকাতের মাধ্যমে সমাজে দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। যাকাত না দেয়া আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার শামিল এবং এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসতে পারে।
হাদীসে ইরশাদ হয়েছে।
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "وما منع قوم زكاة أموالهم إلا منعوا القطر من السماء، ولولا البهائم لم يمطروا.— (ابن ماجه: ٤٠١٩)
নবী করীম (সা.) বলেছেন: "যে জাতি যাকাত বন্ধ করে দেয়, তাদের থেকে বৃষ্টি রুদ্ধ করা হয়। যদি পশুরা না থাকত, তাহলে বৃষ্টিও একেবারেই হতো না।"
এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যাকাত না দেয়ার কারণে আল্লাহ অনাবৃষ্টি নাজিল করেন। যাকাত আল্লাহর দেয়া আদেশ, এবং এটি পালন না করলে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব দেখা দেয়।
উপরের আয়াত ও হাদিসগুলোতে সমাজের তিনটি অপরাধ ও তাদের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও অনাবৃষ্টি আনতে পারে।
ইসলামী শিক্ষায় মানবিক গুণাবলি ও নৈতিকতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। অশ্লীলতা, প্রতারণা এবং যাকাতের অবহেলা মানুষের উপর আল্লাহর ক্রোধ আনতে পারে। ইবনে মাজাহ’র হাদীস ৪০১৯ অনুযায়ী, এই কাজগুলোর পরিণতি সমাজের উপর মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমাদের উচিত, ইসলামের বিধান মেনে চলা এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করা, যাতে সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় থাকে।
إرسال تعليق