প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কবে সংঘটিত হয়েছিলো? যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও মূল কারণ কি ছিলো? (World War I)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (World War I) ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই শুরু হয় এবং ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই যুদ্ধ মূলত ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং সমুদ্রপথে সংঘটিত হয়েছিল এবং এতে প্রধানত ইউরোপের শক্তিগুলো অংশ নিয়েছিল।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (World War I) বিস্তারিত বিবরণে যাবার আগে, এর প্রকৃত কারণ ও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে আরও গভীরে আলোচনা করা যেতে পারে। এই যুদ্ধ শুধুমাত্র ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যকার সামরিক সংঘর্ষ ছিল না; এটি ছিল একটি বৈশ্বিক সংকট, যা পরবর্তী সময়ে বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র ও ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল।

যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও মূল কারণ:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পিছনে কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদী এবং স্বল্পমেয়াদী কারণ ছিল। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো:

১. জাতীয়তাবাদ (Nationalism):
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে জোরদার হচ্ছিল। অনেক দেশ, বিশেষ করে বলকান অঞ্চলে, তাদের নিজস্ব জাতীয় সত্ত্বা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছিল। সার্বিয়া এবং অন্যান্য বলকান দেশগুলো অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য। এ ধরনের জাতীয়তাবাদী আবেগ ইউরোপের বিভিন্ন অংশে বিদ্যমান ছিল এবং এটি দেশগুলোর মধ্যে সামরিক উত্তেজনার অন্যতম কারণ ছিল।

২. ইম্পেরিয়ালিজম (Imperialism):
ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলো এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার উপনিবেশ স্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, এবং অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করতে চাইছিল। এই প্রতিযোগিতা দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল এবং পরোক্ষভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উদ্ভবের পটভূমি তৈরি করেছিল।

. মিলিটারিজম (Militarism):
বৃহৎ সামরিক বাহিনী এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের উন্নয়নের ফলে দেশগুলোর মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ইউরোপীয় শক্তিগুলো ব্যাপক পরিমাণে তাদের সামরিক বাজেট বাড়াতে থাকে এবং নতুন অস্ত্রশস্ত্র উদ্ভাবনে মনোযোগ দেয়। এর ফলে দেশগুলোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে নৌবাহিনীর আধিপত্যের প্রতিযোগিতা। সামরিক শক্তি প্রদর্শনের এই প্রতিযোগিতা যুদ্ধের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।

৪. জোটবদ্ধতা (Alliances):
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলো বিভিন্ন সামরিক জোট গঠন করেছিল। দুটি প্রধান জোট ছিল:
   - ত্রয়ী মিত্র (Triple Entente): যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, এবং রাশিয়া।
   - ত্রয়ী কেন্দ্র (Triple Alliance): জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, এবং ইতালি। (যদিও ইতালি পরে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়)

এই জোটগুলো দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা প্রদান করার জন্য গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু এটি পরবর্তীতে বিশ্বযুদ্ধের পরিসরে সংঘাতকে আরও বিস্তৃত করে তোলে। কারণ যখন একটি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন এর মিত্র দেশগুলোও অটোমেটিক্যালি যুদ্ধে প্রবেশ করে।

৫. আর্চডিউক ফার্ডিনান্ডের হত্যা:
১৯১৪ সালের ২৮ জুন, সারায়েভোতে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্ড এবং তার স্ত্রীকে একটি সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী গাভ্রিলো প্রিন্সিপ হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সরাসরি কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে দোষারোপ করে এবং যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর পর মিত্রশক্তি এবং জোটশক্তির দেশগুলো একে একে যুদ্ধে প্রবেশ করে, ফলে বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল ঘটনাবলী:

১. সারায়েভো হত্যাকাণ্ড (১৯১৪): 
আর্চডিউক ফার্ডিনান্ডের হত্যার পর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যও এতে জড়িয়ে পড়ে।

২. শ্লিফেন পরিকল্পনা (Schlieffen Plan): 
জার্মানি দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ করার আশঙ্কায় প্রথমেই ফ্রান্সের ওপর হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল। জার্মানির এই পরিকল্পনার কারণে বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে জার্মানি আক্রমণ চালায়, যা যুক্তরাজ্যের যুদ্ধে প্রবেশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. পশ্চিম ফ্রন্টের যুদ্ধ (Western Front): 
যুদ্ধের বেশিরভাগ অংশ ইউরোপের পশ্চিম ফ্রন্টে সংঘটিত হয়েছিল, যেখানে জার্মানি ফ্রান্স এবং বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এখানেই মাটির খুঁটি (trenches) তৈরি করে যুদ্ধ চালানো হত, যা পরবর্তীতে ‘ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

৪. রাশিয়ার পতন এবং বিপ্লব (১৯১৭):
রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং দেশে বিপ্লবের সূচনা হয়। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর রাশিয়া যুদ্ধে থেকে সরে যায়, যা মিত্রশক্তির জন্য বড় ধাক্কা ছিল।

৫. যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে প্রবেশ (১৯১৭):
জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণের কারণে এবং জার্মানির জিম্মারমান টেলিগ্রামের কারণে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে প্রবেশ করে। এটি যুদ্ধের ফলাফলকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে।

🔹যুদ্ধের সমাপ্তি:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর, যখন মিত্রশক্তি এবং জার্মানি একটি অস্ত্রবিরতি (Armistice) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির (Treaty of Versailles) মাধ্যমে যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির ওপর কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (World War II) কারণ হিসেবে কাজ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি:

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে:
  • অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
  • জার্মানির সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়ে এবং তাকে বিশাল যুদ্ধক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়।
  • লিগ অব নেশন্স (League of Nations) গঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে এ ধরনের সংঘাত প্রতিরোধ করা।
  • বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক মানচিত্র ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ১ কোটি সৈনিক এবং প্রায় ৭০ লক্ষ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এই ঘটনারা বিশ্বের সামরিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এবং পরবর্তী বিশ্বব্যাপী সংঘাতের ভিত্তি রচনা করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট নিহতের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত বিপুল। সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন, তবে ইতিহাসবিদদের মতে:

1. সৈনিক নিহতের সংখ্যা: প্রায় ১ কোটি (১০ মিলিয়ন)।
2. বেসামরিক নিহতের সংখ্যা: প্রায় ৭০ লক্ষ (৭ মিলিয়ন)।

মোট হতাহতের সংখ্যা:
-নিহত এবং আহত মিলে: প্রায় ৩ কোটি (৩০ মিলিয়ন) মানুষ যুদ্ধে প্রভাবিত হয়েছিল, যার মধ্যে শুধু নিহতদের সংখ্যা ১.৭ কোটি (১৭ মিলিয়ন) এর কাছাকাছি ছিল।

এই বিশাল সংখ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সরাসরি যুদ্ধে নিহতরা, যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, মহামারী, এবং যুদ্ধের অন্যান্য পরোক্ষ প্রভাব।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি (Allied Powers) জয় লাভ করেছিল। মিত্রশক্তির প্রধান দেশগুলো ছিল:

1. যুক্তরাজ্য
2. ফ্রান্স
3. রাশিয়া (যদিও ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর তারা যুদ্ধে থেকে সরে যায়)
4. ইতালি (যুদ্ধের শুরুর দিকে ত্রয়ী কেন্দ্রের (Central Powers) সদস্য ছিল, কিন্তু ১৯১৫ সালে মিত্রশক্তিতে যোগ দেয়)
5. যুক্তরাষ্ট্র (১৯১৭ সালে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে প্রবেশ করে)

পরাজিত শক্তি (Central Powers):
ত্রয়ী কেন্দ্র বা কেন্দ্রীয় শক্তিগুলো ছিল:
1. জার্মানি
2. অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি
3. অটোমান সাম্রাজ্য
4. বুলগেরিয়া

যুদ্ধের শেষের দিকে, মিত্রশক্তি জার্মানির বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালায় এবং ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর জার্মানি অস্ত্রবিরতি চুক্তি (Armistice) স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়। ১৯১৯ সালের **ভার্সাই চুক্তি** (Treaty of Versailles)-এর মাধ্যমে জার্মানিকে কঠোর শর্তের মুখোমুখি করা হয়, যা তাদের অর্থনৈতিক এবং সামরিক অবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।

তথ্য সুত্রঃ Wikipedia, ChatGPT, Google Search Keywords 

Post a Comment

أحدث أقدم
icon যে কোন প্রয়োজনে টেলিগ্রাম চ্যানেলে মেসেজ দিন